লিখন শিখন: ভাষা
দক্ষতার অন্যতম যোগ্যতা
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা
অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
মানব সন্তানের আত্নপ্রকাশের বাহন ভাষা। এর
দুটি রূপ।ধ্বনিরূপ ও বর্ণ বা লিপিরূপ। ধ্বনি বলতে আমরা মানুষের মুখে উচ্চারিত
ভাষাকেই বুঝি।মুখে বলার সাথে শোনার সম্পর্ক একান্ত ঘনিষ্ঠ। কারণ, আমরা কাছের ও
দূরের শ্রোতার উদ্দেশ্যেই কথা বলে থাকি।অন্যদিকে ভাষার লিপিরূপ শিল্প ও সাহিত্যের
সুন্দর সৃষ্টিকে ধরে রাখে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। কারণ বলার স্থয়িত্বের
চেয়ে লেখার স্থায়িত্ব অনেক বেশি। এ কারণে লেখার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষা
দক্ষতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।আবার হাতের লেখা চর্চা শিক্ষা জীবনের প্রধানতম
উপাদান। পড়তে শেখা, পড়ে বুঝতে পারা, শুনে বুঝতে পারা, বুঝে মুখে প্রকাশ করতে পারার
পাশপাশি শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিখণফলের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে লিখনের মাধ্যমে।কিন্তু
সঠিকভাবে লিখতে পারার দক্ষতাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খুব কম
অর্জিত হচ্ছে।কে.জি স্কুলের শিক্ষার্থীরা এ দক্ষতাটি ভালই অর্জন করতে
পারে।প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র কোডিং-কাটিং এবং মূল্যায়নের
সময় যে চিত্রটি দেখা যায়, বলা যায় তা মোটেই সন্তোষজনক নয়, বরং হতাশাজনক।কোন কোন
এলাকার বা বিদ্যালয় বিশেষে লক্ষ্য করা যায় যে, হাতের লিখন চর্চাটা শিক্ষার্থীদের
মোটেই হয়নি।উত্তরপত্রে প্রশ্নোত্তর সঠিকভাবে লেখার কারণে হয়ত শিক্ষার্থীরা পাশ করে
যাচ্ছে। কিন্তু তাদের হস্তাক্ষরের মান উন্নত করার কোন বিকল্প নেই।আর সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা চর্চার উপর অনেক বেশি গুরুত্ব
দিতে হবে। হাতের লেখা চর্চা বিষয়ক সকল দিক তুলে ধরে একটি পর্যালোনা এ নিবন্ধে তুলে
ধরা হলো।
উদ্দেশ্য: নিবন্ধটি পড়ে পাঠকগণ; বিশেষত
শিক্ষকতায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ নিন্মোক্ত দিকগুলো আয়ত্ব করে উপকৃত হবেন।
.
ভাষা
দক্ষতা হিসেবে লিখনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারবেন।
.
লিখন
দক্ষতার বিকাশে পূর্বপ্রস্তুতিমূলক অনুশীলণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পােরবেন।
.
লিখনের
বৈশিষ্ট্যাবলি জানতে পারবেন।
.
লিখন
সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
.
লিখন
শিক্ষাদানের কৌশলসমূহ জানতে পারবেন।
লেখা শেখা/চর্চার গুরুত্ব:
.
মনের
ভাব ধরে রাখা যায়।
.
অতীত,
বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করা যায়।
.
ব্যক্তিত্বের
পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব হয়।
.
বিশ্বের
বিভিন্ন অঞ্চলের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব হয়।
.
সমাজ
ও রাষ্ট্রীয় জীবনে লেখার গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখার প্রয়োজনীয়তা:
.
চিন্তার
শৃংখলা আনয়নে ও বিন্যাসে সাহায্য করে।
.
শিশুর
চিন্তায় ও কর্মের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়।
.
শিশুর
পরিচ্ছন্ন রুচিবোধের বিকাশ ঘটায়।
.
শিশুর
চিন্তা, কল্পনা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে।
.
শিশুর
একাগ্রতা ও মনোনিবেশ বৃদ্ধি পায়।
.
শব্দ
প্রয়োগ ও বানানের ক্ষেত্রে নির্ভুলতা শেখায়।
লেখা শেখার নীতিসমূহ:
.
লিখতে
দেয়ার আগে শিশুর বেঞ্চ এবং ডেস্কের উচ্চতা, উপযোগিতা, বসার ভঙ্গী, লেখার সামগ্রী
ঠিক থাকতে হবে।
.
শিশুকে
মেরুদন্ড সোজা করে বসাতে হবে। কলম বা পেন্সিল ধরার কায়দা শিখিয়ে দিতে হবে।
.
শ্লেট
বা কাগজ/খাতা লম্বভাবে রাখতে হবে। লেখার উপকরণ ঠিক থাকতে হবে (কাগজ, কলম, পেন্সিল,
শ্লেট ইত্যাদি)।
.
সব
অক্ষর যেন সমান মাপের হয়। লাইন টানা খাতা হলে ভাল হয়।
.
শব্দের
অনর্ত্গত বর্ণগুলো যেন সমান দূরত্বের হয়। প্রত্যেক শব্দও যেন সমান দূরত্বের
হয়।আনুপাতিক দূরত্ব বুঝতে পারতে হবে।
.
লেখার
সময় সবগুলো অক্ষর একই ধাঁচের হতে হবে।
.
অক্ষরে
মাত্রা, কার চিহ্ন, ছেদ চিহ্ন, স্বর চিহ্নগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে।
.
লাইন
সমান্তরাল ও সোজা হতে হবে।
.
শিশুদেরকে
ছাপা অক্ষর অর্থাৎ গোটা ও স্পষ্ট অক্ষর দেখে তা লেখার দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা
করতে হবে।
.
লেখা
পরিচ্ছন্ন পাঠযোগ্য হতে হবে।
.
নির্দিষ্ট
সময়ে নির্দিষ্ট লেখা শেষ করতে হবে।
.
শিক্ষকের
লেখা অবশ্যই অনুকরণযোগ্য হতে হবে।
.
শ্রেণির
বিভিন্ন শিক্ষার্থীর লেখা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
লিখনের সমস্যা ও সমাধান:
.
সঠিক
গতিভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করতে হবে।
.
উল্টোদিক
থেকে লেখা শুরু না করার অভ্যাস করাতে হবে।
.
যাদের
লেখার আগ্রহ কম থাকে তাদের আগ্রহী করে তোলা।
.
পারিবারিকভাবে
লেখা শেখার জন্য জোর দিতে হবে।
.
শিক্ষকের
ব্যবহার হতে হবে মমত্ববোধ সম্পন্ন এবং স্নেহশীল।
.
কলম
বা পেন্সিল সঠিকভাবে ধরতে শেখাতে হবে।
.
বা-হাতির
ডান হাতে লেখার জন্য চাপ না দেওয়া এবং তার অভ্যাসকে পরিপক্ক করার প্রচেষ্টা নিতে
হবে।
.
লাইন
সোজা না হলে লিাইন টানা কাগজে লিখে অভ্যাস করাতে হবে।
.
বর্ণ,
শব্দ, বাক্য লিখতে দূরত্ব ঠিক রাখতে হবে।
.
টানা
হাতের লেখার অভ্যাস করাতে হবে।
.
ব্লাকবোর্ডে
লেখার অভ্যাস করাতে হবে।
.
ইংরেজি
ছোট হাতের, বড় হাতের ও বাঁকা (কার্সিভ) হাতের লেখা বিশেষভাবে শিখাতে ও অভ্যাস
করাতে হবে।
.
বানানের
সমস্যা সমাধানের অভ্যাস করাতে হবে।
.
উচ্চারণ
ক্রুটি মুক্ত করাতে হবে।
.
স্বরচিহ্নের
ব্যবহার সঠিক হতে হবে। া, কি, ী িইত্যাদি চিহ্ন যথাস্থানে বসাতে শেখাতে হবে।
.
একই
উচ্চারণে বিভিন্ন বর্ণ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
.
আঞ্চলিকতার
প্রভাব মুক্ত হতে সহায়তা করতে হবে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখা শেখার
ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ:
.
শিক্ষক:
শিক্ষার্থী অনুপাত অনেক বেশি। কোথাও কোথাও ০১ জন শিক্ষক সমান ১০০শরও বেশি
ছাত্র/ছাত্রী।অধিকাংশ শ্রেণিতে ১:৬০ জনের উপরে শিক্ষক:শিক্ষার্থী।
.
অভিভাবকগণ
অসচেতন।
.
পরিবারে
মা-বাবা লেখা চর্চার ব্যাপারে অসচেতন।
.
শিক্ষকদের
অসাবধানতা ও কম গুরুত্ব দেওয়া।
.
পড়া,
লেখা, বলা ও শোনার দক্ষতাগুলোর উপর শ্রেণিতে সম গুরুত্ব না পাওয়া।
.
লেখা
শিখন বা চর্চায় বিশেষ জোর না দেয়া।
.
বগুড়ার
মোকামতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মত ভাল বিদ্যালয়গুলোর লিখন শেখানোর প্রথা
অনুসরণ না করা।
.
শিক্ষকগণ
লিখন শেখানো বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেলেও শ্রেণিকক্ষে তা যত্নসহকারে অনুসরণ না করা।
উপসংহার: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে
কর্মরত শিক্ষকগণ উপরে আলোচিত বিষয়গুলোর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।অধিকাংশই শিক্ষকই এ সব
জানেন ও বুঝেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ ও হাতে-কলমে শেখানোর কাজটা কম করছেন।বিশেষত
বিদ্যালয় পরিদর্শনে অর্জিত অভিজ্ঞতা, সাময়িক পরীক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী
পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রে লেখার ধরণ এবং উত্তরপত্র দেখে মনে হয়েছে,
লিখন শেখানোর কাজটি বিদ্যালয়ে আদৌ অনুশীলণ হয় না।হলেও খুব কম হয়। ‘লেখা শেখানোয়
বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এবং শিশুদের প্রত্যেককে যত্ন সহকারে লিখতে শেখাতে হবে‘; কথাটি
শিক্ষকদের মনে করিয়ে দেয়ার কথা উপলব্ধি করে এ নিবন্ধটি রচনা করা হয়েছে।