করোনার আত্নকাহিনী-০১
আমি করোনা। আমি কাউকে করুনা করি না, পরওয়াও
করিনা। আমি যেদিকে ইচ্ছা ছুটে চলি, যাকে ইচ্ছা আক্রান্ত করি। যাকে ইচ্ছা ছেড়ে দিই,
এড়িয়ে চলি। আমি ছুটে চলি জেট গতিতে। পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে সেই প্রান্তে। আমি সবখানে
বিরাজমান। তোমরা আমার নাম দিয়োছো কোভিড-১৯। আসলে আমি কাউকে চিনি না। আমার নাম যাই হোক
না কেন, আমি এক ভয়ংকর আতন্কের নাম, তোমাদের জন্য। আমি কি করবো না করবো এটা একান্তই
আমার ব্যাপার। তোমরা বড়্ড় বেশি বাড়াবাড়ি করছিলে তাই তোমাদেরকে আমার জাত চেনানোর প্রয়োজন
ছিলো। তাই আমি করছি। ভেবো না তোমরা পাশ কাটিয়ে বাঁচতে পারেবে। কিন্তু পারবে না। আমি
কারও সৃষ্ট নই, কেহই আমাকে সৃষ্টি করে নি। আমি পাষাণি, আমি দানব, আমি হন্তারক ও ভ্রমণ
পিয়াসি এক ছোট্ট কিছু। আমি আসলে ভাইরাসের একটি গোত্রভুক্ত বিশেষ গোত্রের ভাইরাস। আমি
পরিবারের ৭ম সদস্য। আমার আগেই ৬ সদস্য তোমাদের
কাছে এসেছে। তোমরা তাদেরকে ভালভাবে চিনো নি। এখন চিনে নাও। আমার আগের ৬ জনের ৪ জনই
সাধারণ সর্দি-কাশির রূপ নিয়ে এসছিলো। অত:পর আসে মার্স ও সার্স। তারাও দু‘জনও খুনি।
আমি তো মস্ত বড়ো খুনি। আমি একটি রোগ বিশেষ। আমি কোভড-১৯ নামে পরিচিত বেশি। তোমরা কেউ
বলছো করোনা, কেউ বলছো কোভিড-১৯, আবার কেউ বলছো প্রানগাতি। আমি আসলে পরম করুণাময়ের পাঠানো
এক বিশেষ দূত বা সৃষ্টি। আমি রোগ, আমি সর্দি, আমি জ্বর, আমি কাশি। এগুলো আমার ভিন্ন
বিন্ন রূপ। কখনো কখনো আমি তোমাদেরকে পেয়ে বসলে, ব্যথা, নাক বন্ধ, নাক দিয়ে পানি বের
হওয়া, গলা ব্যথা, পাতলা পায়খানাও হবে তোমাদের। আমি কখনো তীব্র হবো, আবার কখনো মৃদু
হবো্। তোমরা সহজে বুঝেও উঠতে পারবে না, তা। কখনো এমন হতে পারে, আমি যে তোমার কাছে এসে
গেছি, সেটা টেরও পাবে না। আমি শুধু তোকে বা তুমি একজনকে ধরি না, তোমার সাথে যারাই থাকবে
সবাইকে খাবো। অতএব, সাধু সাবধান। তোমরা আমাকে নানাভাবে দোষছ। তোমরা ঝগড়া করছো, নিজেরা
নিজেরা। সাধারণত: তোমাদের স্বাস-প্রশ্বাসের কণা আমি। তোমরা আমাকে অনুভবও করতেও পারবে
না, দেখতেও পাবে না। স্বাস-প্রশ্বাসের সাথে বেরিয়ে গিয়ে আমি মরে যাই না, অন্যদের ধরে
ফেলি। কেউ আমার স্পর্শে আসলেই ধরে নাও, বাঁচা কঠিন। তোমরা যারা বুড়ো হয়ে গেছো, খোদাকে
না চিনে হায়াত কাটিয়েছো ৬০ বছর, ৭০ বছর, ৯০ বছর; যা ইচ্ছে তাই করেছো গত ১০০ বছরে তাদেরই
আমি প্রথমে ধরছি। বাকিদের সময় দেবো, কিছুটা। তোমরা এর মধ্যে খোদাকে চিনে নাও, না হলে
আরও ভয়ন্কর রূপ নেবো, আমি। তোমাদের বাড়াবাড়ির সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে স্বয়ং প্রভু আমাকে
তাঁর জাতের প্রতীক হিসাবে প্রেরিত হয়েছি। এ পৃথিবীর ১৮ হাজার সৃষ্টির মধ্যে আকাশে-বাতাসে-ভূমন্ডলে
ছড়ি-ছিটিয়ে থাকা ১৭ হাজার ৯শ ৯৯ টি সৃষ্টিই খোদাকে ২৪ ঘন্টা ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে
যাচ্ছে। আর তোমরা একে ওকে নিত্যই হুমকি ধামকি করো, মারো-মরো, খুন করো, রাহাজানি করো।
খোদা তায়ালা বলেছেন; তিনি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। আর তোমরা হয়ে পড়ো;
৫০ জোড়া, ১০০ জোড়া, ৯৯ জোড়া, ১০০০ জোড়া। কেন রে ভাই খোদা তো তোমাকে অতজনের সাথে ফস্টি-নস্টি
করার অনুমতি দেয় নাই। তোমরা নিজেরা তো নিজেদেরকে মারোই আবার আল্লাহ‘র কুদরাতের হাতেও
নাক ডুকাও। তোমরা ৩০ পারা কুরআনকে ৩১ পারা বানাতে চাও। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি
তোমাদেরকে ‘মুসলমান মুলমানকে, মোমেন মোমেনাতকে, সচ্চরিত্রবান সচ্চরিত্রবানকে..... সঙ্গী
করবে। আর তোমরা নির্বিচারে যা ইচ্ছা তাই করছো। তোমরা আমার প্রতিনিধিদেরকে হত্যা করছো,
কখনও আল্লাহর নামে, কখনো নবীর নামে, কখনো বা তোমাদেরে কাউকে অপছন্দ হলে অপবাদ দিয়ে,
আবার কাউকে জোর করে খ্রিস্টন বানাও, কাউকে জোর করে ইহুদীদের বন্ধু বানাও। এসব কি তামাসা
শুরু করেছো, তোমরা? তোমাদের কেও কেও বলতে শুরু করেছো, ফেরাউনের মতো “আনা-রাব্বুকুমুল
আ‘লা “(আমিই তোমাদের সবচেয়ে খোদা)”। রাখো তোমাদের খোদাগিরি মজা দেখাচ্ছি। যারা আল্লাহর
নাম ধরেছে, যারা তাকেকে সুযোগ পেলেই একটু-আধটু স্মরণ করে, মনে মনে তসবিহ-তাহলির করে,
নির্দিষ্ট সময়ে তার ঘরে যায় ৫ বার, তাকে স্মরণ করতে বিশেষ বেশ-বুশা ধারণ করে, পারলে
তার নামে একটু শ্লোগান দেয়, তোরা সারা পৃথিবীতেই তাদেরকে যেখানেই পাও মারো, ধরো, খুন
করো; আমি কতো চুপ থাকবো? তোমরা আল্লাকে তারা চিনে বলে, কোন নারীকে ইচ্ছামত ধর্ষণ করো,
নির্যাতন করো, পুড়ে মারো, নিজেরাও নিজেদের মারো, ধরো; এসব আর কত? সময় থাকতে শুধরে নাও।
আল্লাহ তো ফেরেমতাদের জিার আপত্তির মাঝেও তোমাদেরকে এ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন, তার
প্রার্থনা-উপাসনা-এবাদত-বন্দেগী করার জন্য , তাকে সবিনয়ে স্মরণ করার জন্য। সুযোগ পেরে
তাকে একটু মনে করো না, ভক্তি-শ্রদ্ধা করো না, তার হুকুম-আহকাম একটু মেনে চলার চেষ্টা
করো না কেন? াাল্হতায়ালা ওেতামাদের উদ্দেশ্যে
কী বলেছে, পড়ে দেখো তো...“তোমরা খালি খালি কেয়ামত নিয়ে প্রশ্ন করো.. আমি না বলেছি;
এটা আসবে, অবশ্যই আসবে, শীঘ্রই আসবে। ..আমি কী তোমাদের জন্য ভূ-মন্ডলকে বিচরণ ক্ষেত্র
করে দেই নি? এবং পর্বতমালাকে পেরেক? আমি তোমাদেরকে জোড়ায়
জোড়ায়
সৃষ্টি
করেছি,
তোমাদের
নিদ্রাকে
করেছি
ক্লান্তি
দূরকারী,
রাত্রিকে
করেছি
আবরণ।
দিনকে
করেছি
জীবিকা
অর্জনের
সময়,
নির্মান
করেছি
তোমাদের
মাথার
উপর
মজবুত
সপ্ত-আকাশ।
এবং
একটি
উজ্জ্বল
প্রদীপ
সৃষ্টি
করেছি।
আমি
জলধর
মেঘমালা
থেকে
প্রচুর
বৃষ্টিপাত
করি,
যাতে
তদ্দ্বারা
উৎপন্ন
করি
শস্য,
উদ্ভিদ।
ও
পাতাঘন
উদ্যান।
নিশ্চয়
বিচার
দিবস
নির্ধারিত
রয়েছে।
যেদিন
শিংগায়
ফুঁক
দেয়া
হবে,
তখন
তোমরা
দলে
দলে
সমাগত
হবে।
আকাশ
বিদীর্ণ
হয়ে;
তাতে
বহু
দরজা
সৃষ্টি
হবে।
নিশ্চয়
জাহান্নাম
প্রতীক্ষায়
থাকবে,
এবং
পর্বতমালা
চালিত
হয়ে
মরীচিকা
হয়ে
যাবে।
সীমালংঘনকারীদের
আশ্রয়স্থলরূপে।
তারা
তথায়
শতাব্দীর
পর
শতাব্দী
অবস্থান
করবে।
তথায়
তারা
কোন
শীতল
এবং
পানীয়
আস্বাদন
করবে
না;
পরিপূর্ণ
প্রতিফল
হিসেবে।
কিন্তু
ফুটন্ত
পানি
ও
পূঁজ
পাবে।
নিশ্চয়
তারা
হিসাব-নিকাশ
আশা
করত
না।
আমি
সবকিছুই
লিপিবদ্ধ
করে
সংরক্ষিত
করেছি।
অতএব,
তোমরা
আস্বাদন
কর,
আমি
কেবল
তোমাদের
শাস্তিই
বৃদ্ধি
করব।পরহেযগারদের
জন্যে
রয়েছে
সাফল্য।
উদ্যান,
আঙ্গুর,সমবয়স্কা,
পূর্ণযৌবনা
তরুণী।
এবং
পূর্ণ
পানপাত্র।
তারা
তথায়
অসার
ও
মিথ্যা
বাক্য
শুনবে
না।
এটা
আপনার
পালনকর্তার
তরফ
থেকে
যথোচিত
দান,
যিনি
নভোমন্ডল,
ভূমন্ডল
ও
এতদুভয়ের
মধ্যবর্তী
সবকিছুর
পালনকর্তা,
দয়াময়,
কেউ
তাঁর
সাথে
কথার
অধিকারী
হবে
না। যেদিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে।
দয়াময়
আল্লাহ
যাকে
অনুমতি
দিবেন,
সে
ব্যতিত
কেউ
কথা
বলতে
পারবে
না
এবং
সে
সত্যকথা
বলবে।
এই
দিবস
সত্য।
অতঃপর
যার
ইচ্ছা,
সে
তার
পালনকর্তার
কাছে
ঠিকানা
তৈরী
করুক।
আমি
তোমাদেরকে
আসন্ন
শাস্তি
সম্পর্কে
সতর্ক
করলাম,
যেদিন
মানুষ
প্রত্যেক্ষ
করবে
যা
সে
সামনে
প্রেরণ
করেছে
এবং
কাফের বলবেঃ হায়, আফসোস-আমি যদি মাটি হয়ে । (সূরা নাবা, আল-কুরআন)” দেখো সারা পৃথিবীতে
ইতোমধ্যে কত মারা গেলো? আমি তাদেরকে মেরে ফেলেছি। তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করো, ধরে থেকো,
আর চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলো। তোমাদের সরকার যা করছে ও বলছে, সেভাবে থেকো। তোমরা
অতি বেশি মাত্রায় সহিংস ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছো তো, তাই আমি এসেছি তোমাদেরকে শুধরাতে।
আমি সর্বশেষ ধরেছি; বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। আস্তে আস্তে রাগব বোয়াল সব ধরে
ফেলবো। আমার নেক্স্ট টার্গেট ডুনাল্ড ট্রাম্প।
দেখো না ইতালি ও স্পেনসহ সকল দেশে কতজন দলে দলে মরছে? “করোনা
ভাইরাসে
আক্রান্ত হয়ে বিশ্বজুড়ে ২১ হাজার একশ ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন পর্যন্ত ভয়াবহ দিন। সে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজার ৪৮ জনে ঠেকেছে। তবে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির দাবি, নতুন করে ১৬৪ জনের প্রাণহানির পর যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে নয়শ ৪৪ জন। তবে তিনশ ৯৪ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এদিকে যুক্তরাজ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারশ ৫৬ জনে। নতুনভাবে আক্রান্ত হয়েছে আরো দেড় হাজার মানুষ। স্পেনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার চারশ ৩৪ জন। ইতালিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ছয় হাজার আটশ ২০ জনে ঠেকেছে। অন্যদিকে ফ্রান্সে মারা গেছে ১৩৩১ জন। সার্বিয়াতে দুই শিশু আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখা গেছে, চীন এবং ইতালির পরেই যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের হার ১.৩৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ৭০ লাখ থেকে দেড় কোটি মানুষ আক্রান্ত হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে। এদিকে স্পেনে গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। স্পেনে এখন পর্যন্ত ৪৭ হাজার ছয়শ ১০ জন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। জানা গেছে, দেশব্যাপী ভোট করোনাভাইরাসের কারণে স্থগিত করে দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।করোনা মোকাবেলার জন্য চীন থেকে ৭৮৪ মিলিয়ন ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনছে স্পেন। তার মধ্যে পাঁচশ মিলিয়ন মাস্ক, ৫.৫ মিলিয়ন টেস্ট কিট এবং ৯৫০টি ভেন্টিলেটর রয়েছে।স্পেনের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মাদ্রিদের একটি আশ্রম থেকে ২৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে ইরানে গতকাল ১৪৩ জনের মৃত্যুর ফলে মোট ২০৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটল। আমার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য
পুতিন বলো, আর ট্রামপ্ বলো সবাই উঠে-পড়ে
লেগে গেছে। আরও বেশি করে লেগে থাকো, দেখো এবার আমার আক্রমণ হতে বাঁচাতে পারো
কিনা। কত কিছু করছো, তবু মহান প্রভুকে কেন
স্মরণ করো। অপেক্ষা খেকে আরও ভয়ন্কর কিছু সামনে আসছে। এবার এক পলক বিশ্বব্যাপী
ভ্রমণ করে এসো সাংবাদিক কামল আহমদ ভয়ে তোমাদের সামনে কী তুলে ধরেছেন দেখো;
“করোনাভাইরাসের মহামারি যে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংকট, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এটি যেমন জনস্বাস্থ্যগত সংকট, তেমনই দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সংকট। ‘আমাদের এমনটি হবে না’, ভাবনাটি ইতিমধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত এ ধরনের বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় কতটা অপ্রস্তুত, তা–ও এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের আগে আরও শতাধিক দেশে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে। ফলে অজানা শত্রুর ভয়ংকর থাবা থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর সবচেয়ে কার্যকর কৌশল বেছে নেওয়ার কিছুটা সুযোগ আমাদের সামনে রয়েছে। তাই বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে কী কী শিক্ষা আমরা নিতে পারি্ করোনার সংক্রমণ যেখানে প্রথম ঘটেছিল, চীনের সেই উহানে নতুন কোনো সংক্রমণ ঘটেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেছেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উহান সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মাধ্যমে বাকি বিশ্বের জন্য আশা জাগিয়েছে। প্রতিদিনই আমরা এই ভাইরাস সম্পর্কে শিখছি। চীনের শাসনব্যবস্থার কর্তৃত্ববাদী চরিত্র এবং বিপুল সম্পদ বিনিয়োগের সামর্থ্য অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। চীন ভাইরাসটির সংক্রমণ উহানেই সীমিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যান্য দেশে সে রকমটি হচ্ছে না। চীনের বাইরে সংক্রমণের ব্যাপ্তি এবং ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়েছে যেসব দেশে, সেগুলো হচ্ছে ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা এখনো অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের পরিস্থিতি অবশ্য অন্য কারও সঙ্গেই তুলনীয় নয়। তবে এসব দেশ চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালি থেকে শিক্ষা নিয়ে কৌশল পরিবর্তনেও পিছপা হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক হারে শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালিয়ে সংক্রমিতদের দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। আর বাইরে থেকে আসা প্রবাসী ও বিদেশিদের সেলফ কোয়ারেন্টিনে নজরদারিতে মোবাইল অ্যাপসের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছে। ইতালিতেও যেখানে সংক্রমণের সূচনা, সেই ভো নামক গ্রামের তিন হাজারের বেশি বাসিন্দার সবাইকে সংক্রমণ শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের সাফল্য মিলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইউরোপের সেরা চিকিৎসাব্যবস্থার সুনাম থাকলেও ধনীদের বসতি হিসেবে পরিচিত লম্বার্ডি এলাকায় সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বলা হচ্ছে আশির ওপরে বয়স, এ রকম একটি প্রজন্ম পুরোপুরি হারিয়ে যাচ্ছে।যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশেই শুরুর দিকে গলদ থাকায় দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল কারণ ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির রাজনীতি এবং সমস্যার বিপদকে নাকচ করা। আর যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার ভাইরাসের সংক্রমণ অল্প সময়ের ব্যবধানে আরও শক্তিশালী রূপে ফিরে আসার আশঙ্কা বিবেচনায় জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠতে দেওয়া প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কথিত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ কৌশলে রোগী শনাক্তকরণের বদলে কারও মধ্যে লক্ষণ দেখা দিলে তাকে স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের নীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
যে গবেষণা সব বদলে দিয়েছে:
অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ইম্পিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক নিল ফার্গুসনের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় যখন সম্ভাব্য ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়, তখন দ্রুতই সরকার তার কৌশলে পরিবর্তন আনে। ধারণ (কনটেইন) নীতির বদলে শুরু হয় অবদমন (সাপ্রেশন) নীতি বাস্তবায়নে পর্যায়ক্রমিক লকডাউনের পথে যাত্রা। প্রথমে বড় ধরনের সমাবেশ বন্ধ করা, অফিসের বদলে বাসায় বসে কাজ করতে উৎসাহিত করা, সত্তরোর্ধ্ব ও কয়েক ধরনের নিরাময়যোগ্য নয় এমন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছান্তরীণ করার পরামর্শের পর গত শনিবার থেকে বার, রেস্তোরাঁ ও ক্লাবগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। লন্ডনে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সেখানে এখন একধরনের অঘোষিত লকডাউন চলছে। শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী জনসন নাগরিকদের উদ্দেশে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশনা মেনে চলার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এবং অন্য আরও কয়েকটি জনঘন শহর ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অবশ্য গত সপ্তাহ থেকেই সরকারিভাবে লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। বিধিনিষেধ অমান্য করলে জরিমানাও করা হচ্ছে। অধ্যাপক নিল ফার্গুসনের গবেষণায় বলা হয় যে সংক্রমণের ধারাবাহিকতা ভাঙতে না পারলে যুক্তরাজ্যের ৬০ শতাংশ মানুষ সংক্রমণের শিকার হবে এবং মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। প্রশমনের ব্যবস্থা না নিলে তা পাঁচ লাখও হতে পারে। ওই গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে এবং ট্রাম্প প্রশাসনও দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠে।
গুরুত্বপূর্ণ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে: ১. এসব দেশে করোনা–সংকটকে এখন শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সংকটকে স্পষ্টতই দুটো ভাগে ভাগ করে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে এবং প্রয়োজনমতো সেগুলোতে রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে জনস্বাস্থ্যগত এবং অপরটি অর্থনৈতিক। ২. জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমঝোতা ও মতৈক্যের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলায় সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেমন ডেমোক্র্যাট স্পিকার পেলোসি এবং বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নরদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন, ঠিক তেমনই যুক্তরাজ্যে বরিস জনসন বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন এবং অন্য দলগুলোর সঙ্গে এবং মন্ত্রীরা ছায়ামন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত সলাপরামর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ৩. সরকারের স্বাস্থ্যবিধিবিষয়ক নির্দেশনাগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং ব্যাখ্যা তুলে ধরছেন বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। ৪. সংক্রমণ ও প্রাণহানির তথ্য প্রকাশে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে। ৫. শনাক্তকরণের সরঞ্জাম (কিট) এবং চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহের বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ঘাটতি পূরণে উৎপাদকদের কাছ থেকে সরাসরি এগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। ৬. হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বাড়াতে জীবন রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক নয় এমন সব অস্ত্রোপচার পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আট হাজার শয্যা এবং কয়েক হাজার ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীর সেবা গ্রহণের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ চুক্তি করেছে। আর গত তিন বছরে অবসরে গেছেন, এমন প্রায় ৩৫ হাজার ডাক্তার ও নার্সের প্রতি কাজে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৭. ইতালিতে ক্রিটিক্যাল কেয়ার দেওয়ার শয্যার সংখ্যা যেখানে প্রতি এক হাজার রোগীর বিপরীতে ১২টি, সেখানে যুক্তরাজ্যে এর সংখ্যা তার অর্ধেকের কম। ক্রিটিক্যাল কেয়ারের জন্য অপরিহার্য ভেন্টিলেটর মেশিনের অভাবের কারণে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কায় গত সপ্তাহে সরকার স্থানীয় শিল্প খাতের প্রতি তাদের যন্ত্রপাতিতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়ে ভেন্টিলেটর তৈরি করে দেওয়ার আহ্বান জানায়। মোটর রেসিংয়ের জন্য বিখ্যাত ফর্মুলা ওয়ান ঘোষণা করেছে যে তারা ভেন্টিলেটর উৎপাদন করবে। এ রকম আরও কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের কলকারখানায় কিছুটা রূপান্তর ঘটিয়ে ভেন্টিলেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে এবং আগামী সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে তারা ৩০ হাজার ভেন্টিলেটর সরবরাহ করবে। ৮. সেনাবাহিনীর সরবরাহ পরিকল্পনাকারীদের স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশে স্বেচ্ছান্তরীণ ১৫ লাখ পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগান দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কাজে লাগানো হয়েছে।
অর্থনীতি সচল রাখতে জরুরি ব্যবস্থা: ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতি এবং পেশাজীবীদের মতামত নিয়ে সবাইকে আস্থায় নেওয়ার নীতি অনুসৃত হচ্ছে। মানুষের জীবন রক্ষাকে প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করে স্বাস্থ্য খাতের নজিরবিহীন চাপ মোকাবিলায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির ধস রক্ষায় জরুরি কর্মসূচি ঘোষিত হচ্ছে। উন্নত অর্থনীতির সব কটি দেশেই নজিরবিহীন আর্থিক প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্যাকেজ এক ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে। সেখানে নাগরিকদের হাতে সরাসরি নগদ টাকা পৌঁছানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে বাজারে চাহিদা বজায় থাকে। শিল্প এবং পুঁজিবাজার সচল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। একই ধরনের ব্যবস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারগুলো গ্রহণ করেছে। ব্রিটেনে প্রথমে বাজেটে তিন হাজার কোটি পাউন্ড বরাদ্দের ঘোষণা দেওয়া হলেও সপ্তাহ না ঘুরতেই অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক ঘোষণা করেছেন, অর্থনীতি সচল রাখতে সরকার ‘যা দরকার হবে তা’-ই করবে। নতুন ঘোষিত প্যাকেজে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য আরও ৩৫ হাজার কোটি পাউন্ডের সংস্থান রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজেটের দিনে সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়েছিল ০.২৫ শতাংশে। কিন্তু শুক্রবার তা কমিয়ে ০.০১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, যা ২৩৫ বছরের ইতিহাসে কখনো হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার আগে শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে কাউকে চাকরিচ্যুত না করার আহ্বান জানিয়েছেন। বেসরকারি খাতের সব কর্মীর বেতনের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত দেওয়ার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করেছে। আপাতত তা তিন মাসের জন্য এবং প্রয়োজন হলে তা আবারও বাড়ানো হবে। বাড়ি বা স্থাবর সম্পদের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধে তিন মাসের অবকাশ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্থাপনার ওপর যে কর দেয়, সেই বিজনেস রেট এক বছরের জন্য মওকুফ করা হয়েছে। ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুদান এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কর পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভাড়া দিতে না পারার কারণে কাউকে উচ্ছেদ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে স্বাধীন পেশাদার যেমন সুতোর মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, একাকী ব্যবসা পরিচালনাকারীদের মতো ব্যক্তিদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ না দিয়ে তাদের জন্য বেকার ভাতাসহ অন্য কিছু সুবিধাভোগের শর্তগুলো সহজ করা হয়েছে।
এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি: আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার দোলাচলে অস্থির নাগরিকদের সাহস ও আস্থা জোগানোর জন্য সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক গোষ্ঠী ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জনস্বাস্থ্য–সম্পর্কিত শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের এই কার্যক্রমে যুক্ত না করে শুধু আমলানির্ভর নীতিকৌশল কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে। কোন ধরনের পদক্ষেপে সংক্রমণ কতটা ব্যাপকতা লাভ করতে পারে এবং তাতে সম্ভাব্য জীবনহানির ঝুঁকি কতটা, তার একটা পরিষ্কার চিত্র প্রয়োজন। (ক্রমশ: