স্বনামধন্য চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ
ও অভিভাবক-জনগোষ্ঠীর ভাবনা
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমন একটি
সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে যে, যার সুনাম কক্সবাজার জেলা তথা সারা দেশে ছড়িয়ে
পড়েছে। চকরিয়া ও কক্সবাজার, বান্দরবান এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যালয়ে পড়াশোনায় আকর্ষণ বোধ এবং অধ্যয়নরতরা গৌরব বোধ করে থাকে।এসব এলাকার
বিপুল সংখ্যক অভিভাবক ভাল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনার কথা
ভাবার সময় এ বিদ্যালয়টিও তাঁদের প্রথম বিবেচনায় থাকে।এক সময় চকরিয়া উপজেলার আরেকটি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুটাখালীর কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয়টি বেশ খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম
হয়েছিল।আশির দশকে ও নব্বইয়ের দশকে এ বিদ্যালয়ের সুখ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
উক্ত বিদ্যালয় হতে পাশ করা শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে পরবর্তী শিক্ষাস্তরগুলো
সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত হয়েছে, হতে
পেরেছে। এক সময় খুটাখালী কিশলয় উচ্চ বিদ্যলয়টির শিক্ষার্থীরা দলে দলে চট্টগ্রাম
কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইন্জিয়ারিং কলেজ (এখন বিশ্ববিদ্যালয়), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে দেখেছি
এবং শুনেছি। আমি এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক জনাব চৌধুরী মোহাম্মদ তৈয়ব স্যারের সাথে একবার বছর
দু‘/এক আগে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল্।
তিনি তখন সদ্য সরকারিভাবে লন্ডন সফর করে ফিরে এসে চকরিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসে কি
একটা কাজে এসেছিলেন। সেসময় তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে আমার মতবিনিময়ের সুযোগ
হয়েছিল।তাঁর শিক্ষা জীবন ও কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশ-সুনামকরণসহ
সব বিষয় আলাপ করেছিলাম। যাহোক, লিখছিলাম চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ-এর বর্তমান ও অতীত
খ্যাতি এবং করণীয় বিষয়ে।বিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে শত শত অভিভাবক বাসা-বাড়ী ভাড়া
করে বসবাস করে সন্তানদের এখানে পড়াশোনা করাচ্ছেন।আর পার্শ্ববর্তী কৈয়ারবিল,
বরইতলী, কাকারা, ডুলহাজারা, সাহারবিলসহ ৪/৫ কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকাগুলো হতেও শিক্ষার্থীরা
প্রতিদিন কষ্ট করে চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠে এসে পড়াশোনা করছে।আশ-পাশে চকরিয়া সদরের
শিক্ষার্থীরা তো পড়ছেই। কিশলয়ের মত বর্তমানে চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ হতে পাশ করে
যাওয়া শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা সব উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাস্তরের
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়ন করছে ও অধ্যয়ন শেষে আকর্ষণীয় সব পেশায়, ভাল ভাল
চাকুরিতে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে।কিন্তু ইদানিং
স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং অভিভাবকদের মাঝে কোরক বিদ্যাপীঠের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে
কিছুটা বিরূপ মন্তব্য এবং গুণ্জণ শোনা যায়। অত্র এলাকার সন্তান হিসেবে এবং শিক্ষা
নিয়ে কাজ করার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও এ বিদ্যালয়ে পড়াশোনকারি শিক্ষার্থীর অভিভাবক
হিসেবে কোরক বিদ্যাপীঠ নিয়ে আমার কিছু পরামর্শ আছে বলে মনে করি।বিগত ৮/৯ বছর ধরে
আমার সন্তানদের এ বিদ্যালয়ে পড়তে দিয়েছি এবং বাসা নিয়ে বসবাস করে আসছি। আর বিদ্যালয়টির কার্যক্রম খুব
কাছ দেখে আসছি। এ স্বনামধন্য চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠকে আমাদের কক্সবাজার এলাকার
একটি দেশ সেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কথা এখনই ভাবতে হবে বলে আমার মনে হয়।খুশির
খবর হলো, চকরিয়া তথা কক্সবাজার জেলার কৃতি সন্তান এবং চকরিয়া উপজেলার মাননীয়
উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্ব জাফর আলম বি.এ অনার্স, এম.এ; মহোদয়ের মত শিক্ষা
অনুরাগী ব্যক্তিত্ব এ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করে শক্ত
হাতে এর হাল ধরেছেন।। এ মুহুর্তে চকরিয়াবাসীর জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর
মত যে কোন কিছুতে অবদান রাখতে পারেন এমন আর কেহ নেই। চকরিয়াবাসীর উচিত তাঁকে
সার্বিক-সহযোগিতা এবং অকুন্ঠ সমর্থন দেয়া। তাঁর কোন বিকল্প নেই।আর বিদ্যালয়
পরিচালানার সাথে আরও যুক্ত হয়েছেন;
চকরিয়ার নেতৃস্থানীয় ব্যক্ত্বিত্ব জনাব আলহাজ্ব নুরূল আবছার, চকরিয়া
উপজেলার আরেক কৃতি সন্তান জনাব মো: আজিমূল হক চেয়ারম্যান, এ বিদ্যালয়ের এককালীন
শিক্ষক এবং বর্তমানে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চকরিয়ার কৃতি
সন্তান-শিক্ষাবিদ জনাব মো: আবু শোয়াইব, সাবেক চেয়ারম্যান জনাব আলা উদ্দিন আজাদসহ
স্বনামধন্য ব্যকিবর্গ। এবার চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠের একজন শুভার্থী হিসেবে কিছু
পরামর্শ তুলে ধরছি।
১। বিদ্যালয়ে কর্মরত
শিক্ষকমন্ডলীর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ: প্রাথমিক স্তর এবং মাধ্যমিক স্তর
পর্যায়ে কর্মরত শিক্ষকগণের জন্য পেশাগত মানোন্নয়ন ও দায়িত্ব-কর্তব্য পালন,
তথ্য-প্রযুক্তি ভিত্তিক বা মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদান, অত্যাধুনিক পাঠদান
পদ্ধতি, উপকরণ সংগ্রহ ও ব্যবহারকরণ, শিশু বিষয়ক আইন-কানুন, জেন্ডার বিষয়ক ধারণা প্রদান,
অধ্যয়নশীলতা, সবল-দূর্বল শিক্ষার্থীদেরকে দক্ষতার সাথে পাঠদান, বিশেষ চাহিদা
সম্পন্ন এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করার কৌশল, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের
সাথে আচার-ব্যবহার, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ ও
সম্পর্ক রক্ষাসহ যাবতীয় বিষয়ে শিক্ষকদের দক্ষ্, যোগ্য এবং সমৃদ্ধকরণসহ বিবিধ বিষয়ে
প্রশিক্ষণের আয়োজন করা প্রয়োজন।
২। শিক্ষানুরাগিদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন: সমগ্র কক্সবাজারবাসীর
সহযোগিতা নিয়ে বিশেষত: চকরিয়া উপজেলার শিক্ষানুরাগি ব্যক্ত্বিগণের একটি সমাবেশ
ডেকে তাঁদের মতামত-পরামর্শ গ্রহন করে বিদ্যালয়টিকে হাজার বছরের স্বনামধন্য একটি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটাকে রূপদানের জন্য দূরদর্শী একটি পরিকল্পনা তৈরি করে তা
ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
৩।সমৃদ্ধ লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাকরণ: শিক্ষার্থী-শিক্ষকমন্ডলী সবাইকে
যুগোপযোগি জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং পৃথিবীর তাবত সব লেখক-সাহিত্যিক, গুণি ব্যক্তিগণের
বইপত্র ও তাঁদের বইগুলো পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরী
প্রতিষ্ঠা করলে খুবই ভাল হয়।
৪। বিজ্ঞানাগার স্থাপন: অত্যাধুনিক সব উপকরণ এবং যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ একটি
স্বতন্ত্র বিজ্ঞানাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়োজন।
৫।কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠাকরণ: তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ও এ
সবের ব্যবহারে শিক্ষকমিন্ডলী এবং শিক্ষার্থীদেরকে অবাধ সুযোগ করে দেয়ার জন্য একটি
কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন।
৬। ইংরেজি শিক্ষা ও বিজ্ঞান ক্লাব ক্লাব স্থাপন: ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও
দক্ষতা অর্জন এবং গণিত-বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে শিক্ষার্থী-শিক্ষকমন্ডলীকে
অবারিত সুযোগ করে দেয়ার জন্য একটি করে পৃথক পৃথক ল্যাবা বা ক্লাব গঠন ও স্থপান
করতে পারলে খুবই ভাল হয়।
৭।মতবিনিময় সভার আয়োজন: অন্তত তিন/চার মাস পর পর একবার করে
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী (বিশেষত পি.এস.সি,
জে.এস.সি এবং এ.এস.সি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে) মতবিনিময় সভার আয়োজন করা প্রয়োজন।
৮।সক্রিয় ম্যানেজিং কমিটি: বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকে সক্রিয় রাখা এবং
নিয়মিত সভা আহবান, সিদ্ধান্ত গ্রহন এবং তা নিবীডভাবে মনিটরিং করে পুরোপুরি
বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
৯।বিদ্যালয়ের ভামূর্তি উজ্জ্বলকরণ: প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বলকরণ
এবং এর সুনাম বৃদ্ধি করার জন্য ইভটিজার ও উশৃংখল শিক্ষার্থীদেরকে চিহ্নিত করে
তাদের বহিস্কারকরণসহ কঠোর সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
১০।প্রধান শিক্ষক নিয়োগ: বিদ্যালযটির প্রধান শিক্ষক পদে এমন একজন
শিক্ষাবিদ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যাক্তিত্বকে নিয়োগ দেয়া আবশ্যক; যিনি হবেন চকরিয়া পাইলট
সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক জনাব নূরূল কবির চোধুরী বা নূর
মোহাম্মদ বাঙ্গালী অথবা চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন স্বনামধন্য প্রধান
শিক্ষক জনাব নুরূল কবিরের মত বা সে মাপের না হলেও, অনুরূপ মানের একজন
ব্যক্তিত্ত্বকে।
১১। শিক্ষকদের জন্য কিছু কথা: চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠে কর্মরত
শিক্ষাকমন্ডলকে হতে হবে দূরদর্শী, পেশাজীবীসুলভ মনোবৃত্তি সম্পন্ন, নিজ নিজ বিষয়ে
দক্ষ ও সমৃদ্ধ । আর তাঁদের মনে রাখা প্রয়োজন, এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ৫/১০/২০ বছরের
জন্য নয়, চিরদিরে জন্য। সুতরাং এর সুনাম অক্ষুন্ন রাখা এবং এর মান কাংখিত পর্যায়ে
উন্নীত করার ক্ষেত্রে তাঁদের দায়-দায়িত্ব মোটেই কম নয়।
১২।সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম জেরিদারকরণ: শিক্ষার্থীদের জন্য
সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম বিশেষত: সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, নাটক চর্চা এবং
অভিনয়ের প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ভাষা, গণিত ও
বিজ্ঞান চর্চামূলক প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা,
জাতীয় দিবসগুলো ঝাঁকজমকের সাথে পালনের জন
বিশেষ অনুষ্ঠান ও প্রযোগিতা এবং পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানাদির আয়োজনসহ এ
ধরণের কাজগুলো বেশি বেশি আয়োজন করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীদের উন্নত অভিরুচি
তৈরি, মানস গঠন, সাংস্কৃতিক বোধ সৃস্টি, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ
ও সমৃদ্ধ হওয়া, দেশজ ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালভাবে জানা, সৃজনশীলতা এবং সুকুমার
বৃত্তির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটবে।
পরিশেষে বলব, উপরে বর্ণিত ভাবনাসমূহ বা পরামর্শগুলো একান্তই
আমার নিজের।আমার নিজের সন্তানরা বিগত প্রায় এক দশক ধরে চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠে
পড়াশোনা করছে। স্ব-পরিবারে বিদ্যালয়টিতে সন্তানদের পড়াশোনার সুবিধার্থে বাসা ভাড়া
করে বসবাস করছি।কিছু কিছু অভিভাবককে দেখেছি ও শুনেছি যে, এ বিদ্যালয়ের সার্বিক
কার্যক্রমে তারা খুবই অসন্তোষ্ট এবং বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন।প্রতিষ্ঠানটিকে দরদ
দিয়ে ভালবাসি বলে এবং চকরিয়ার একজন সন্তান হিসেবে নিজের অনুভুতিগুলো এখানে প্রকাশ
করলাম। যারা এ বিদ্যালয়কে এবং শিক্ষার মানকে গুরুত্ব দেন, তাঁরা অন্তত আমার সাথে
বর্ণিত বিষয়গলো নিয়ে সহমত পোষণ করবেন।আমার এ নিবন্ধটি কারও পছন্দ না হলে, ক্ষমা
চেয়ে নিচ্ছি।জিতে রহো, চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন