একজন প্রধান শিক্ষকের আত্নকথা
আমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক।মহেশখালী
উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের টাইমবাজার এলাকায় আমার বিদ্যালয়ের অবস্থান। আমি স্পষ্ট
কন্ঠে কথা বলতে পছন্দ করি। যা কিছু সত্য বলে জানি ও মনে করি, আমি তা নি:সন্কুচে
বলে ফেলি। আমি আমার শিক্ষক সমাজের সুখে-দু:খে পাশে থাকি। শিক্ষকতা জীবনে অবসরের
দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছি, আমি। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমি আমার বিদ্যালয়টিকে
ভীষণ ভালবাসি এবং শক্ত হাতে এটাকে পরিচালনা করি।কিন্তু শিক্ষক স্বল্পতা যেন আমার
বিদ্যালয়টিকে পিছু ছাড়ছে না। ফলে, গুটি কয় সহকর্মী শিক্ষক নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা
করতে গিয়ে আমাকে খুব কষ্ট করতে হয়। কষ্ট পাই, শিক্ষকের অভাবে কোন কোন সময়
শিক্ষার্থীরা যখন পাঠ হতে বঞ্চিত হয়। আমার বিদ্যালয়ে নব-নির্মীত একটি ভবন ইউনিয়ন
পরিষদের দখলে। তারা সাময়িকভাবে অফিস চালানোর কথা বলে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবণটি
নির্মাণ কাজ শেষ হলে দখলে নেয়। কিন্তু চার/পাঁচ বছর হতে চলল, তারা দখল ছেড়ে দিচ্ছে
না। আমার মনোকষ্টের কথা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বার বার অবহিত করলেও সুরাহা হচ্ছে
না। আমার সংগ্রাম চলছে, চলবে আমার বিদ্যালয় ভবণটি ফিরে পাওয়ার জন্য।বিদ্যালয়ের সকল
শিক্ষার্থী আমার প্রিয় সন্তান তুল্য। আমার নিজের একমাত্র কন্যাকে আমি চিকিৎসক
বানিয়েছি। পাত্রস্থও করেছি একজন চিকিৎসকের হাতে। আমার বিদ্যালয় শিশুরা আমার অতি
নিকটজন। তাদের ভালবাসায় নিজেকে আকন্ঠ সিক্ত করি, আমি প্রতিদিন।সদা ভাবি তাদের
উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে।তাঁরাও আমাকে ভালবাসে ও মানে খুব। ঠিক সকাল সাড়ে আটটায় আমি
বিদ্যালয়ে প্রবেশ করি। আর বের হই পাঁচটায়। কখনও বা সন্ধ্যায়। আমার বিদ্যালয় সংলগ্ন
মাঠটি বেশ বড় ও প্রশস্ত। আমার বিদ্যালয় শিশুরা আনন্দে-হিল্লোলে দুলতে দুলতে খেলতে
খেলতে আসে-যায়। আমি দেখি, তাদের আচার-আচরণ। কখনও হাসি, কখনও কষ্ট পাই, যখন দেখি
তারা দুষ্টুমী করে, মারামারি করে, কান্নাকাটি করে। আমি পড়াশোনা করেছি, আলীয়া
মাদ্রাসায়। ছিলাম, এককালে মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার শিক্ষক। মানুষের সেবায় নিয়োজিত
থেকে মানুষের মনকে নিস্কলুষ করে তোলাই যেন যে আমার নিয়তি। অত্যন্ত পরিশ্রম করে আমি
নিজের জীবনেও সুখ-স্বাচ্ছন্দ বয়ে এনেছি। আল্লাহ তায়ালার প্রতি হাজার বার শুকরিয়া
জানাই, আমাকে এ জমিনে দৃঢ় পায়ে হাঁটার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। কর্মজীবনে, আমি কয়েকটি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। যেখানেই ছিলাম,
বিদ্যালয় এলাকার অনেক গরীব-দূ:খী মানুষের সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করেছি। অনেককে
পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সহায়তা করেছি। আমার
ধর্মনিষ্ঠা, কর্মনিষ্ঠা, শিক্ষকতার মহান পেশা, উদার মানস দিয়ে এবং সমাজকে এগিয়ে
নেয়ার পবিত্র বাসনা নিয়ে সদা কাজ করেছি, করে যাচ্ছি। আমার দিবস-রজনি কাটে মানুষের
সেবায় ও আল্লাহ তায়লার এবাদত-বন্দেগীর মাঝে। আমি আল্লাহ তায়ালার পবিত্র কাবা ঘরে
গিয়েছি, দুই দুবার। আমি নিজেকে যেমন সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছি, শিক্ষক
সমাজকেও নেতৃত্ব দিয়ে, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে, সহাযোগিতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
এগিয়ে যেতে প্রেরণা যোগাচ্ছি। তাঁরা আমাকে বিপুল মেন্ডেট দিয়ে তাঁদের সমিতির সভাতি
নির্বাচন করেছেন, সে ২০০৭ সালে। মহেশখালীর
মত দ্বীপাঞ্চলে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছি, আমি, আমরা সকলে মিলে। চলার পথে অনেক
বাধা-বিপত্তি, মতভিন্নতা ও সহকর্মীদের মধ্যকার ত্ক্তি সম্পর্ক আমাকে ব্যথিত করে,
আমি বিভক্তি দেখে কখনওবা ভেঙ্গে পড়ি। আবার সকল সহকর্মীকে আগলে রেখে মহেশখালীর প্রাথমিক
শিক্ষাকে সাফল্যের পানে এগিয়ে নিতে একাকার হয়ে যাই। আমার কষ্ট হয়, কোন সহকর্মী
শিক্ষক যখন দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ঠ হন। কোন শিশু যখন বিদ্যালয় বিমুখ হয়, তখনও
খুব কষ্ট পাই। কষ্ট পাই, কোন শিশু যখন বিদ্যালয়ে অভর্তি থেকে যায়। বাজারে,
দোকান-পাটে, মাঠে-ঘাটে কোন শিশু যখন বিদ্যালয়ে না এসে কাজ করতে দেখি, মনে খুব কষ্ট
পাই। চেষ্টা করি, তাদেরকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে, সহায়তা দিয়ে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে।
এভাবে আমি দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছি, অনেককে। তৈরি করে
দিয়েছি, তাদের জন্য আলোকময় ভবিষ্যত। আমার বিদ্যালয়ের সহকর্মী শিক্ষকদেরকেও আমি খুব
ভালবাসি। তাঁদেরকে উৎসাহ দিই, সুযোগ দিই, শিক্ষার্থীদেরকে ভালভাবে গড়ে তুলতে।
তাঁরা নিষ্ঠার সাথে আমার সহযোদ্ধা হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, শিক্ষক শূন্যতা
সত্বেও শিশুদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে, তাদেরকে কেনভাবে বঞ্চিত না করতে। আমার বিদ্যালয়ের
প্রত্যেক শিশু মানসম্মত শিক্ষা পাবে, এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা আমাদের লক্ষ্য
অর্জনে অবিচল। আমার শিক্ষার্থীরা সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমেও বেশ চৌকশ। তারা
প্রাথমিক শিক্ষাক্রমভুক্ত পাঠ্য বিষয়গুলোতে যেমন পটু হয়ে ওঠছে, তেমনি সকল দিক দিয়ে
প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের যোগ্য শিক্ষার্থী। আমার মন:পীড়ার আরেকটি কারণ সীমানা
প্রাচীর না থাকায়, আমার বিদ্যালয়ের শিশুরা পার্শ্বস্থ গাড়ি চলাচলের রাস্তায় ওঠে
পড়ে। তাদের আসা-যাওয়ার পথে কখন দুর্ঘটনার শিকার হয় তার, আমি এ নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন
থাকি। আমার বিদ্রালয়ের বেশ কজন শিশু এমন দুঘৃটনায় পড়ে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমি
এলাকাবাসী ও কর্তৃপক্ষের নিকট আমার কাজ নিয়ে কতটা সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারছি,
জানি না। তবে আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমি আমার কর্তব্য-কর্মে কোন অবহেলা করি
না। অনেকে আমাকে পছন্দ করে, আবার অনেকে আড়ালে-আবোলে অনেক কথা বলে। কিন্তু আমি কাজ
করছি, করে যাব। আমি একা নই, আমি সবাইকে সাথে নিয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর এ পিছিয়ে
থাকা জনপদকে আলোকিত করার কাজটি করে যাব। জয়তু, প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক
বিদ্যালয়, শিক্ষকমন্ডলী এবং প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন