মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০১৭

Tareq Fatah

তারেক ফাতাহ জ্ঞানী মুসলিম:
তিনি কী ইসলাম বিরোধী?
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ*
তারেক ফাতাহ কানাডা প্রবাসী মুসলিম বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বিশ্লেষক এবং পন্ডিত ব্যাক্তি। তিনি ধর্মরিপেক্ষতায় বিশ্বাসী, মানবাধিকার কর্মী উদারপন্থী ব্যাক্তিত্ত্ব হিসেবে সুপরিচিত। তবে তিনি এখন কট্টর ভারতপন্থী এবং খুব বেশি পাকিস্তান বিরোধী হয়ে ওঠেছেন। তারেক ফাতাহ পাকিস্তানের করাচীতে ১৯৪৯ সালের ২০ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং সেখানকার মুসলিম সংগঠন মুসলিম কানাডীয়ান কংগ্রেস নামক একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ধর্ম রাষ্টের আলাদা ভূমিকা চান, শরিয়াহ আইনের বিরোধী এবং উদারতাবাদ, ইসলামের প্রগতিশীল রূপ দেয়ার পক্ষে ব্যাপক প্রচারনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কট্টরপন্থী মুসলমানরা তাঁর কর্মকান্ড এবং বক্তৃতা-বিবৃতির তীব্র বিরোধীতা করছে।
তারেক ফাতাহ জীবন শিক্ষা:
১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির সময় তার পরিবার ভারতের মুব্বাই হতে পাকিস্তানের করাচীতে বসতি স্থাপন করে। তিনি ১৯৬০ ১৯৭০-এর দশকে বামপন্থী ছাত্র ছাত্র নেতা ছিলেন। তারেক ফাতাহ করাচী বিশ্ববিদ্যালয হতে জৈব রসায়ন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিী অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে করাচী সান পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। আর তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেন, এক সময়। পাকিস্তানের সামরিক শাসনামলে তারেক ফাতাহ দুবার কারারুদ্ধ হন। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হকের শাসন চলাকালে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্টদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় এবং পাকিস্তানের সাংবাদিকতা জগতে তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তিনি পাকিস্তান ত্যাগ করে সৌদি আরব চলে যান। পরে, ১৯৭৮ সালে সেখান হতে কানাডায় স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেন। নিজের পরিচিতি তুলে ধরে তারেক ফাতাহ বলেন; “আমি ভারতীয়, জন্মেছি পাকিস্তানে পাঞ্জাবী মুসলিম পরিবারে। আর বসতি গড়েছি কানাডায় অভিবাসী হিসেবে। সচেতন মুসলমান আমি। মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিয়েছি আমি যৌবনে। আমি সালমান রুশদীর অভিহিত মধ্যরাতের শিশুদের একজন। আমাদেরকে বৃহত একটি সভ্যতা হতে ছিটকে পড়ে অভিবাসী জীবন বেছে নিতে হয়েছে। আর মহাসমুদ্রে সাঁতার কেটে কেটে আমাদেরকে কূলে ভিড়তে হয়েছে।তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তারেক ফাতাহ বলেন, “আমি লেখালেখি করি মুসলমান হিসেবে, যাদের পূর্বপুরুষ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আমার ধর্ম ইসলামের উৎস হলো ইহুদীবাদ। আবার আমার পাঞ্জাবী সংস্কৃতি শিখদের সাথে একাত্ন হয়ে আছে। এই যে, আমি বহু সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছি, তা সত্বেও ইসলামপন্থীরা দাবি করে আমার বহুত্ববাদী পরিচয় প্রত্যাখান না করলে, আমি মুসলিম দাবি করতে পারব না।” 
রাজনীতিক মানবাধিকার কর্মী ফাতাহ:
তিনি কানাডার অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বব রাইয়ের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। দলটির প্রার্থী হিসেবে তিনি ১৯৯৫ সালে আঞ্চলিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। অত:পর তিনি হাওয়ার্ড হ্যাম্পটন নামক আরেক রাজনীতিকের পক্ষে কাজ করেন। এনডিপি ছেড়ে তারেক ফাতাহ অত:পর লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব কানাডায় (এলডিপি) যোগদান করেন এবং বব রাইকে সমর্থন করেন। যাহোক, বিশ্বাসগত কারণে তিনি বার বার দল বদল করেন। এক পর্যায়ে তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারে নামেন এবং মুসলিমদেরকে কানাডায় অভিবাসনের সুযোগ না দেয়ার দাবি তুলেন।
সংবাদকর্মী ইসলামের সমালোচক হিসেবে তারেক ফাতাহ:
১৯৯৬ সাল হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি কানাডার সিটিএস এবং ভিশন টিভি-তে চলমান ঘটনা প্রবাহ এবং মুসলিম সম্প্রদায় বিষয়ক সাপ্তাহিক একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেন। ২০০৩ সালে তাঁর মহিলা সহযোগি ইরশাদ মাঞ্জির সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ইরশাদ মঞ্জিও ইসলামী বিষয়ের একজন লেখিকা। তিনিদ্যা ট্রাবল উইথ ইসলামবইয়ের লেখক। ইরশাদ মঞ্জি বইটি লেখার ক্ষেত্রে তারেক ফাতাহর অবদানের কথা স্বীকার করেন। ফাতাহ বইটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, বইটিতে মুসলমানদের কথা বলা হয় নি, বলা হয়েছে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারিদেরকে নিরাপদ বোধ করার পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। ২০০৭ সালে ম্যাকলিন সাময়িকীতে কানাডার সবচেয়ে পরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় ৫০ জন ব্যাক্তিত্ত্বের তালিকা প্রকাশ করা হয়, যেখানে তারেক ফাতাহ নামও স্থান পায়। তিনি এভাবে বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠান এবং টকশো উপস্থাপন আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করে আসছেন। তারেক ফাতাহ টরেন্টো সান পত্রিকায় কলাম লিখেন। তিনি টাইম ম্যাগাজিন, টরেন্টো স্টার, ন্যাশনাল পোস্ট এবং গ্লোব এন্ড মেইল নামক পত্রিকায়ও তাঁর মতামত-ভাষ্য ইত্যাদি লিখেন। তিনি বর্তমানেফাতাহ কি ফতোয়াশিরোনামে ভারতের জি নিউজ চ্যানেলে একটি টক শো আয়োজন করছেন। অনুষ্ঠানটিতে মুসলামানদের বিষয়সহ বিবিধ বিষয়ে প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখানে বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের তীব্রভাবে সমালোচনা করা হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস হতে চালু হওয়া অনুষ্ঠানটির প্রবল বিরোধীতা করছে মুসলামানরা। তিনি সুযোগ পেলেই পাকিস্তানকে তুলোধুনা করে ছাড়েন। তারেক ফাতাহ ইসরাইল রাষ্ট্রের সমর্থক। তিনি ইরাক দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছিলেন। তারেক ফাতাহ কুরআনের বিরুদ্ধে বলেন না। তিনি ইসলামকে বিতর্কিত করার জন্য ৮ম ৯ব শতাব্দীর ইসলামিক স্কলাদেরকে দায়ি করে থাকেন। আর তিনি মুসলিম জঙ্গী সৃষ্টি করার পেছনে সৌদি আরব এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা নিআইএ-কে দায়ি করেন। তারেক ফাতাহ মতে ইসলামকে সংস্কার করার প্রয়োজন নেই, যা প্রয়োজন তা হলো; মুসলমানদেরকে আধুনিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে নিতে হবে। তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণার ঘোর বিরোধী। তিনি একটি বই লিখে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরোধীতা করেন। তারেক ফাতাহ তাঁর ধর্ম ইসলাম মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ব্যাপারে বলেন, তিনি ধর্ম নিরেপক্ষ উদারতাবাদে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, ইসলাম মুসলিম রাজনীতি এবং এর নেতাদের নিয়ে গৌরব করার মত কিছু নেই।আমার ধর্ম আমাকে সত্য বলার সাহস যোগায় এবং সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে বলেতিনি এমনভাবে নিজেকে তুলে ধরার প্রয়াস চালান। তিনি বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। আমি চাই, মুসলমানরা আধুনিকতার চর্চা করুক। তাদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠুক দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী; যেমনটা ঘড়ে ওঠেছিল বাগদাদে যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠায় অন্দোলনের সময়
ভারতীয় মুসলমানদের তারেক ফাতাহ সম্পর্কে মতামত
তারেক ফাতাহ চমৎকার যুক্তি দিয়ে সাহসিকতার সাথে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেণ। কিন্তু তিনি এমন একটা ভাব নেন যে, তিনি যেন ইসলাম মুসলমানদের ব্যাপারে নতুন কিছু বলছেন। আসলে তাঁর মতামতের কোন মূল্য মুসলমানদের কাছে নেই। ইসলাম ধর্ম তার জায়গায় আছে। ডা: জাকের নায়ক যেমন ইসলাম সম্পর্কে বিমূর্ত কথা-বার্তা বলে সাধারণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন, ঠিক তেমনি তারেক ফাতাহও ইসলাম মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবলিলায় নানা কথা-বার্তা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। আসলে তারা দুজনই প্রচার-প্রপাগান্ডার যুগে নিজস্ব মাহাত্ন্য জাহির করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। তারেক ফাতাহ তসলিমা নাসরিন, সালমান রুশদী, ভিএস নাইপল, আইয়ান হিরসী আলী প্রমুখের মত পাশ্চাত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, ইসলাম মুসলমানদের আক্রমণ করে। তিনি মুসলমান হিসেবে কুরআনকে স্বীকার করেন মানেন বলে দাবি করেন, কিন্তু সুন্নাহ, খেলাফতের শাসন, শরিয়াহ, ফিকহা এসব মানেন না, বলে তা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন
উপসংহার: তারেক ফাতাহ মত অতীতে অনেকে মুসলমান হয়েও ইসলাম মুসলমান বিরোধী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। নিজেদেরে দাবি করেছেন, যুক্তিবাদী, মার্ক্সবাদী, উদারতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ; প্রভৃতি। ইসলামী খেলাফতের প্রথম দিকে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের অনুসারিরা ইসলামী বিশ্বাসের উৎসসমূহ; যেমন-কুরআন, সুন্নাহ, এজমা, কিয়াছ, ইজতিহাদ প্রভৃতি বিষয়ে ভিন্নতর ব্যাখ্যা উপস্থাপন এবং তা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইসলাম এবং মুসলমানরা সহজাত ধারায় এগিয়েছে, প্রচার-প্রসার ঘটেছে। বর্তমানেও হাজার হাজার মানুষ ইসলামকে বরণ করে নিচ্ছে ভালবেসে নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে। এঁদের মধ্যে আছেন, অনেক বড় মাপের অধ্যাপক, ধর্মগুরু, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সংবাদকর্মীসহ বিবিধ পেশার ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ। ইসলামের ক্ষতি করতে পারবে না, কেহই। যত বাধা-বিপত্তি আসুক ,ইসলাম মুসলমানরা সাময়িক ভুলভ্রান্তিতে জড়ালেও, তা নিজস্ব গতিতে চলবে, চলছে। ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের বিতর্কিত কোন মতামত-অবস্থান একে প্রভাবিত করতে পারবে না।
*
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মহেশখালী, কক্সবাজার


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন