শিক্ষায় আধুনিকতা: শিখণের
কিছু ভিন্ন ভিন্ন কৌশল
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
শিক্ষায় ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার শিখণ-শেখানো কার্যক্রমে
অত্যাধুনিক ভাবনার সংযোজন। এর ফলে শিক্ষার সকল স্তরে দেশ-বিদেশে ব্যাপক নতুনত্ব
এবং ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবন ঘটিয়েছে। সনাতন পদ্ধতির শ্রেণি পাঠদানে গভীর প্রভাব
ফেলেছে, এটি। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের ভবনায় এবং কাজে এর প্রভাব দিন দিন
দৃশ্যমান হয়ে ওঠছে। মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন এবং ভিডিও-অডিও
ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদান পদ্ধতি সারা বিশ্বে অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠছে। উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগেই এর প্রচলন ঘটেছে। এশিয়ায় চীন, জাপান, ভারতসহ
সকল দেশে শিখণ-শেখানো কাজে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বিশাল প্রভাব ও প্রসার ঘটেছে।
তাঁরা শিক্ষকগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, মাল্টিমিডিয়া
শ্রেণিকক্ষ তৈরি, প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম সরবরাহসহ
যাবতীয় কাজে বেশ উন্নয়ন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমান সরকার সকল স্তরের অধিকাংশ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া সরবরাহ করেছে এবং এক বছরের মধ্যে হয়ত সকল
প্রতিষ্ঠানে তা পৌঁছে যাবে। এ নিবন্ধে একজন মার্কিন শিক্ষাবিদের ধারণার আলোকে শ্রেণি
শিখণ-শেখানোতে বিশ্বব্যাপী ৪৮টি টি নতুন কলা-কৌশলের প্রয়োগ বিষয়ে আলোকেপাত করার
প্রয়াস চালাব।
১.
শ্রেণিকক্ষে বৈচিত্রতা আনয়ন: আধুনিক শিক্ষাবিদগণ উচ্চতর
তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারতা লাভের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণি শিখণ-শেখানোর সময়
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চলন-বলন, লিখন, আদেশ-নির্দেশ-উপদেশ দান এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতে
নিত্যই নতুনত্ত্ব নিয়ে আসছেন। তাঁদের ভাবনা সনাতন পদ্ধতিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে
অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শিখণফল বা যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। সুতরাং শিক্ষকদেরকে
নতুন পরিস্থিতিতে নিজেদের সনাতন ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। নিজেদেরেকে এ
যুগের শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ি পাঠদান করার পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করে নিতে হবে। প্রথম
শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে এমন শিক্ষার্থী যদি
২০১৭ সালে ৬ মাস পার করার পরও বাংলা বইয়ের পাঠ্যাংশ বিশেষ পড়তে পারবে না, এটা কোন
মতেই মানা যায় না। অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকগণকেই কাজটি করতে হবে।
২. সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে: অন-লাইনে আজকাল হাজার হাজার শ্রেণি শিখণ-শেখানোর
কন্টেন্ট ও উপকরণ পাওয়া যায়। ইউটিউব, শিক্ষক বাতায়ন, মুক্ত পাঠ, ব্যক্তিগত ও গ্রুপ
ভিত্তিক শিক্ষকগণের বিবিধ ব্লগে প্রবেশ করলে, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকগণ তাঁদের পছন্দ
মত পাঠ পরিকল্পনা ও পাঠ সহজেই খুঁজে পাবেন। তাছাড়া, ফেসবুকেও প্রচুর শ্রেণি
পাঠদানের উপকরণ ও লেখা-লেখি পাওয়া পাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত সকল
স্তরের শিক্ষকগণ অন-লাইনে নিজেদের কর্মকান্ড বিস্তার করুন্ নিজেকে সমৃদ্ধ করুন,
নিজের ভাবনা-কাজ-চিন্তা অন্যকে শেয়ার করুন এবং নিজেদেরেকে দক্ষ ও উপযোগি করে নিন।
৩.শিক্ষা,
শিক্ষাদান ও শিখণ-শেখানো বিষয়ে কথা বলুন: আদি যুগ হতে মানব
সমস্যা ও চাহিদার অন্ত নেই্। আর এসব চাহিদা ও সমস্যা নিয়ে সারাক্ষণ না ভেবে যারা
নিজেদের চলার পথ তৈরি করে নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন, তাঁরাই সফলকাম হয়েছেন। আর যারা
শুধু যেখানে-সেখানে সমস্যার বেড়াজালে আঁটকা পড়ে অনর্গল রাজা-উজির মেরে মেরে দিন
কাটিয়েছেন তারা সফল হতে পেরেছেন, এমন মানুষ খুব কমই। আমার কথা হলো, আমরা যারা
শিক্ষক-কর্মকর্তা-কমচারি শিক্ষার কাজে নিয়োজিত তাঁদের অধিকাংশ সময় শিক্ষার কাজেই
কাটানো উচিত। হাঁটে-ঘাটে-দোকানে বসে বসে বাজে আড্ডায় মেতে না থেকে একটা উত্তম
শ্রেণি পাঠ তৈরি করা অনেক উপকার বয়ে আনে।
৪.
শ্রেণির বাইরেও শিখণ-শেখানো চালাতে হবে: আজকাল শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধাগুলো মোবাইল-টেব-রিডার-লেপটপের
কল্যাণে সহজেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ থেকে
লেকচার শুনার আগ্রহ হারাতে বসেছে, অনেকটা। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে পাঠদান স্থান
পাল্টানোর কথা ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে
কখনো কখনো শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গনে বা অন্য কোথাও অথবা
অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ফলে, এদেরকে
শিখণ-শেখানোতে আরও মনোযোগি করা য়ায় বলে আধুনিক শিক্ষাবিদগণ অভিমত ব্যক্ত করছেন।
৫.
মেয়ে শিশু বা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবুন: মেয়ে শিশুদের মোটেই
অবহেলা করবেন না। তাদেরকে শিখণসহ সকল কাজে ছেলে শিক্ষার্থীদের সমান অংশিদার করুন।
তারা নিরুৎসাহিত হয়, ভয় পায়, বা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে এমন আচার-আচরণ বা
পরিস্থিতি সৃষ্টি বিরথ থাকুন। নারীরাও এ পৃথিবীর সকল ভাল কাজ উন্নয়নের সমান
অংশিদার। তাদের প্রতি সহানুভূতি শীল হোন, তাদের সমস্যাগুলোকে বড় করে না দেখে
সহায়তা করুন, স্বভাবিকভাবে শিখতে, পড়তে ও বেড়ে ওঠতে দিন। সমাজে-রাষ্ট্রে সর্বত্র
পুরুষের সাথে মেয়েরাও পাল্লা দিতে পারে, একথা আজ সকল বিবেচনায় প্রমাণিত সত্য।
৬.
কোন শিক্ষার্থীই বা শিশুই ফেল নয়, সম্পদ: পৃথিবীতে চীন ও ভারত
সবচেয়ে জনসংখ্যা বিশিষ্ট দেশ। কিন্তু দু‘টি দেশই আজ প্রথম সারির উন্নত দেশ, সকল
বিবেচনায়। প্রায়ই শোনা যায়, এলাকা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, নৃগোষ্ঠীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর
সন্তানরা পড়াশোনা পারদর্শি হয় না। কথাটা সত্য নয়। আমার কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য
একটি অধ্যায় কেটেছে হাওর, পাহাড় এবং দ্বীপাঞ্চলে। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে বলতে পারি,
শিক্ষকগণ এধরণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের নিয়ে সদা হতাশা প্রকাশ করেন। থানচি
উপজেলার ম্রু জাতির একটি শিশু যদি সেখানকার শিক্ষকদের পাঠ গ্রহণ করে বিশ্ব সেরা
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠতে পারে, অন্য এলাকার শিশুরাও
অবশ্যই পারবে। শুধু দরকার তাদেরকে শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহি ও সভ্য হওয়ার ওঠার প্রেরণা
যোগানো। আর প্রত্যেক মানব শিশুই সম্পদ, বোঝা নয় এ বোধ তাদের মধ্যে জাগ্রত করে
দেয়া।
৭.
সামাজিক মর্যাদা বোধ সৃষ্টি করা: শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলো সকল শ্রেণী-পেশা-জাতি-ধর্ম-বর্ণ তথা সর্ব স্তরের মানুষের সম্পদ।
এখানে, বিশেষত: সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষালয়গুলোতে সকল শিশু শিক্ষার্থী পড়াশোনা করার
সমান সুযোগ রয়েছে। কোন ব্যক্তি বা বিশিষ্ট পরিবারের শিশুকে বিশেষভাবে দেখার বা
সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে সবা্র প্রতি সমান দৃষ্ঠিভঙ্গিতে ও অবাধে পড়াশোনা করতে দিতে হবে। সকল শিশুর সমান সামাজিক
মর্যাদা একই রকম হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এটাই কাম্য। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুরা
এতে বেশ উৎসাহ পায় এবং অন্যদের পাশাপাশি তারও সুশিক্ষিত ও সুসভ্য হওয়ার পথে এগিয়ে
যায়।
৮.
পাঠ সমীক্ষার ধারণা প্রচলন: এ ধারণাটি জাপানে প্রথম প্রচলন
করা হলেও, সকল দেশে পাঠ সমীক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও সকল উপজেলায়
এ বিষয়ে শিক্ষকগণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। অন্তত: প্রধান শিক্ষকগণ এটি গ্রহণ
করেছেন। পাঠ সমীক্ষা বা লেসন-স্টাডি হলো; এমন এক পাঠদান পদ্ধতি যাতে সহকর্মীদের
সক্রিয় সহযোগিতায় প্রতি মাসে একজন শিক্ষক একটি ভাল পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করে শ্রেণি
পাঠদান করা। সাধারণত: গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয়ের জটিল এবং দুর্বোধ্য পাঠ্য
বিষয়বস্তুগুলোর শিখণ ফল অর্জন করানোর জন্য পাঠ সমীক্ষা পদ্ধতি বেশ কার্যকর বলে
প্রমাণিত। একজন শিক্ষক মাসের শুরুতে পাঠ-সমীক্ষার আলোকে শ্রেণি পাঠদানের একটি খসড়া
পাঠ পরিকল্পনা সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব করবেন। সহকর্মীগণ তাঁকে পাঠ
পরিকল্পনাটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার জন্য বিবিধ পরামর্শ প্রদান করবেন এবসংশ্লিষ্ট
শিক্ষক প্রাপ্ত পরামর্শগুলো তাঁর পরিকল্পনায় সমন্বয় করে নিবেন। তিনি সহকর্মীদের
উদ্দেশ্যে তা পুণরায় উপস্থাপন করবেন। মাসের শেষের দিকে সে পাঠ-পরিকল্পনার আলোকে
শিক্ষার্থীদেরকে সরাসরি শ্রেণিতে উপস্থাপন করবেন। আর তাঁর শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম
উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সহ সহকর্মী শিক্ষকগণ তাতে উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষন করবেন। এ
পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে, প্রতিটি বিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার আবহই
বদলে যাবে। সারাবিশ্বে এটি একটি অত্যাধুনিক শ্রেণি পাঠদান পদ্ধতি হিসেবে বেশ
জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে।
৯. পিছিয়ে
শিক্ষার্থীদেরকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নেয়ার কৌশল অবলম্বন:
এটিও জাপানী উদ্ভাবন। শিক্ষাদানের নতুন কৌশল। শ্রেণিতে সকল শিক্ষার্থী পড়াশোনায়
সমান পারদর্শি হবে বা সবাই শিক্ষক কতৃক পাঠ উপস্থাপনের পর অনেক শিক্ষার্থী শিখণ ফল
বা যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। সাধারণত: এধরণের শিক্ষার্থীদেরকে সে সব শিখণ ফল বা
যোগ্যতা পূণরায় অর্জন করারনোর জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আর শিখণ ফল বা
পাঠের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ এসব শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষকদের নিবীড তত্ত্বাধানে
রেখে অব্যাহত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিখণ ফল বা যোগ্যতাসমূহ অর্জন করানোই
হলো ইতিবাচক লড়াই চালানোর বিশেষ পাঠদান পদ্ধতি। এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর একটি
শিখন প্রচেষ্টা।
১০.
বিদ্যালয়ের গন্ডির বাইরের বিকল্প শিখণ: এমন কিছু কিছু
শিক্ষার্থী পাওয়া যায় যে, তারা স্কুলে বা প্রাতিষ্ঠানিক শিখণ-শেখানোর পরিমন্ডলে
শিখণে ব্যর্থ হয়, কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদেরকে পারদর্শি করে তোলা যায়।
এসব শিক্ষার্থীদেরকে কম্পিউটার বা মাল্টিমিডিয়ার সামনে হাজির করে এবং তাদেরকে এসব
প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দেয়া তাদের শিখন ফলপ্রসূ হয়। শিখণ-শেখানোর সনাতনী অনেক
কলা-কৌশল প্রযোগের পরও যে সব শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অর্জিত হয় না, তাদেরকে পড়াশোনায়
পারদর্শি করার জন্য এ পদ্ধতিটি কাজে লাগানো যেতে পারে।
১১.
সমস্যা ভিত্তিক শিখণ: মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরকে কোন
একটি সমস্যা সমাধান করতে দিয়ে শেখানোর এ কৌশলটি অস্ট্রেলিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। বাস্তব
জীবনের কোন একটি সমস্যা শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে একযোগে সমাধান করার দায়িত্ব দেয়া
হলে সবাই মিলে তা সমাধানের মাধ্যমে তাদের শিখন ফল অর্জন সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
শিক্ষকের চেয়ে এখানে শিক্ষার্থীদের ভূমিকাই মুখ্য থাকে।
১২.
প্রযুক্তির সহায়তায় শিখন: কম্পিউটার, প্রজেক্টর, স্ক্রিন
এবং অন্যান্য শিখণ-শেখানো প্রযুক্তিগত উপকরণ শিক্ষার্থীদের জন্য উম্মুক্ত করে দিয়ে
শিখন বিষয়বস্তু এবং পাঠের কাংখিত শিখন ফল বা যোগ্যতা অর্জনের দায়িত্ব দিয়ে তাঁদের
কাজ তাদেরকে করতে দেয়ার মাধ্যমে এ ধরণে শিখণ-শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ
পদ্ধতিটিও অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োগ করে বেশ সাফল্য পাওয়া
গেছে। আমাদের দেশে ধীরে ধীরে পদ্ধতিটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
১৩.
কাঠামোবদ্ধ শিখন পদ্ধতি: শিক্ষার্থীরা নিজেদের ধারণাজাত
পদ্ধতিতে পাঠের শিখন ফল আয়ত্ত্ব করার প্রচেষ্টা এটি। তাদের নিজেদের অনুসৃত এবং
নিজেদেরই উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে, এমন একটি শিখন-শেখানো কৌশল
এটি। প্রাচীন গ্রীসে এটি অনুসরণ করা হতো। সাধারণত: এ ধরণের পদ্ধতি বর্তমানে তেমন
একটা কার্যকর না থাকলেও, ক্ষেত্র বিশেষে এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
১৪.আন্তর্জাতিক
শিখণ ফল: অনেক দেশে আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোকে শিখণ-শেখানোর পাঠ্য
বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারণ করে শিখন ফল অর্জন করানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
সাধারণত: কানাডাসহ বেশকটি দেশ আন্তর্জাতিক শিক্ষাথীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এ
পাঠদান পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে।
১৫.
উন্মুক্ত পদ্ধতির শিখণ: বাংলাদেশের উন্মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সারা পৃথিবীতে সকল স্তরের পড়াশোনায় অন-লাইনে উন্মুক্ত পদ্ধতি
শিখণ-শেখানো চালু করা হয়েছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের পদ্ধতি অনুসরণ করা
যেতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যারা নিয়মিত গমনাগমন করতে ও পড়াশোনা চালিয়ে যেত
পারে না, তাদের জন্য এটা চালু করা যেতে পারে।
১৬.যোগ্যতা
ভিত্তিক শিখণ: মার্কিন শিক্ষাবিদ বেঞ্জামিন ব্লুম পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
শিক্ষার্থীরা জানা বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন বা নিজেদের প্রয়োজনে বিশেষ কোন
বিষয়ে বা ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করার প্রচেষ্টা এটি। এখানে সময়-সীমা নির্ধারিত
থাকে না। নির্ধারিত যোগ্যতাসমূহ অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা চলে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পদ্ধতিটি অনুসৃত হচ্ছে।
পাঠ্যবইগুলো যোগ্যতা ভিত্তিক পদ্ধতিতে
রচনা ও ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রথম হতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ২৯ টি
প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করার কথা নির্ধারণ করা আছে। আবার শ্রেণি ভিত্তিক ও বিষয়
ভিত্তিক যোগ্যতা এবং শিখনফলসমূহও নির্ধারণ করা আছে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা
বয়স, সামর্থ্য এবং ধারণ ক্ষমতা ব্যবহার করে ৫ বছরে ধাপে ধাপে প্রাথমিক স্তরের জন্য
প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে যোগ্যতাসমূহ অর্জন করছে।
১৭.
ব্লগোনা প্রসেস: ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। উচ্চ
শিক্ষা স্তরে পদ্ধতিটি প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। সরকারি কর্তৃপক্ষ,
বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক এবং ছাত্র/ছাত্রী, সংশ্লিষ্ট অংশিজন, কর্মচারি,
আন্তার্জাতিক সংস্থাসমূহ যৌথভাবে এ ধরণে পদ্ধতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত
থাকেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর ছাত্র/ছাত্রীরা অন্য দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে
পড়াশোনা করে থাকে। অর্থাৎ পারস্পরিক শিক্ষার্থী বিনিময়ের মাধ্যমে মান সম্মত শিক্ষা
নিশ্চিতকরণকল্পে এ শিক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে
শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বিনিময়ের ব্লগোনা প্রসেস পদ্ধতি মানসম্মত শিক্ষার প্রসারে
ব্যাপক ও কার্যকর কৌশল।
১৮.
কর্মমুখি শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করানোর কৌশল: শিক্ষার্থীরা যাতে
শিক্ষা গ্রহণ শেষে বিশে দক্ষতা নিয়ে কর্মে প্রবেশ করতে পারে সে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা
অজৃন করানোর বিশেষ কৌশল এটি। শিক্ষারত অবস্থায় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বিশেষ
বিশেষ কারিগরি দক্ষতা অর্জন করানোর মাধ্যমে এ কৌশলটি অবলম্বন করা হয়। শিক্ষা
সমাপনের সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা এতে কোন একটি চাকুরি খুঁজে পায়।
১৯.
হার্বার্ট স্টেইন্স নী ল: হার্বার্ট স্টেইন্স ছিলেন মার্কিন
অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। তাঁর শিক্ষাদান
পদ্ধতিটি হার্বার্ট স্টেইন্স নী ল হিসেবে পরিচিত। তাঁর ল-তে বলা হয়েফে,“
কোন কিছু যাদি চিরস্থায়ী না হয়, তবে তা স্তব্ধ হয়ে যায়।” শিক্ষা ক্ষেত্রের ভেতরের
ও বাইরের অনেকেই এটাকে শিক্ষাগ্রহণকারি এবং শিক্ষাদাতাগণের জন্য জাগরণী বাণীর মত।
এ পদ্ধতি যে কোন শিক্ষা পরিবেশে সক্রিয়ভাবে পরিবর্তন বয়ে আনে এবং অনুসরণীয় হিসেবে
পরিগণিত হচ্ছে।
২০.
অন-লাইন পদ্ধতি শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারি:
অনেকে মনে করেন অন-লাইন শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া সনাতনী শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতির দার
উন্মোচন করে দিয়ে এটাকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। আবার অনেকে মানে করেন এতে
শিক্ষার মান অর্জনকে ব্যাহত করছে। মার্কিনীরা এটাকে সংকট হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের
ধারণা একারণে বেকারত্ব সৃষ্টি করছে এবং তারা চীন এবং ভারতের চ্যালেঞ্জের সন্মুখিন
হচ্ছে। এর বিকল্প হিসেবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন সব উদ্ভাবনী শিক্ষা
পদ্ধতি গ্রহণ করা।
২১.উন্মুক্ত
উদ্ভাবন: এটি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে। ব্যবসায় ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি
প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে কোম্পানীর জন্য নতুন নতুন ব্যবসায় ক্ষেত্র উন্মোচন করে
দেয়। উচ্চ শিক্ষা স্তরে এ কৌশলটির প্রয়োগ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত শিখণ-শেখানো ভাবধারাকে এক সো্রতে নিয়ে আসে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট
কতগুলো ক্ষেত্রে আবদ্ধ না থেকে নতুন দিগন্ত খোলে দেয়।
২২.উঁচু
মানের শিক্ষক: উঁচু মানের শিক্ষক পেতে হলে, উপযুক্ত বেতন-ভাতা দিতে হবে
তাঁদেরকে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ এটি। উচ্চ মানের
শিক্ষক সৃষ্টি করার প্রয়াস চালানোর চেয়ে শিক্ষকতা পেশার প্রতি গুরুত্ব দেয়াই হবে
উত্তম। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাবিদ পাসি শেলবার্গ মনে করেন যে, শিক্ষকদেরকে অধিক হারে
বেতন-ভাতা প্রদান করতে হবে এবং তা যৌক্তিক। ফিনল্যান্ডে শিক্ষা বিষয়ে উচ্চতর
ডিগ্রী অর্জন করা আইন বিষয়ে অথবা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রী অর্জন করার চেয়ে অধিক
কঠিন। অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষার জন্য শিক্ষকদেরকে উপযুক্ত মর্যাদা
দিতে হবে।
২৩.ফিনল্যান্ডের
শিক্ষা পদ্ধতি: ফিনল্যান্ডে মানসম্মত শিক।ষা নিশ্চিতকরণ এবং শীর্ষস্থান
দখল করার কৌশলের চেয়ে প্রত্যেককে মানসম্মত শিক্ষাদানের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
অন্য অনেক দেশের মত ফিনল্যান্ড প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করে না, অথবা এমন কি পঞ্চম
শ্রেণি পাশ না করলে কোন গ্রেড দেয়া হয় না। তারা কঠোর কোন পদক্ষেপ গ্রহনেও বিশ্বাস
করে না, তারা বরং আস্থা এবং সমাতা অর্জনকে উৎসাহিত করে।
২৪.
সামাজিক সহায়তা প্রদান কৌশল: নারী শিক্ষাকে সাংগঠনিক এবং
সামাজিক সংগঠনসমূহের মাধ্যমে উৎসাহ যোগাতে হবে। এত তারা আত্নবিশ্বাস অর্জন করে এবং
অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহসিকতার অধিকারি হয়। এতে নারী জীবন সফল হয়।
২৫.
চেঞ্জ এজেন্টস: শিক্ষকগণই পারেন শিক্ষায় পরিবর্তন এবং গুণগত মান বৃদ্ধি
করতে। তারাই পারেন একটি জাতিকে উন্নয়নের পথ দেখাতে। তাঁরা চাইলেই শিক্ষায় সব কিছু
করা সম্ভব, অন্য কেহ নয়। কোন পদ্ধতি বা কৌশলই শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে করে না। তাঁরা
স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। যে কোন পরিস্থিতিতে
বা সীমাবদ্ধতাই থাক না কেন, তাঁরা শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাদান করে যান। তারাই চেঞ্জ
এজেন্ট।
২৬.কমন
কোর চেঞ্জ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কে-১২ নামে শিক্ষা স্তরে কমন কোর
পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে। ভাষা শিখণ ও গণিত বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করানোর উপর
এখানে গুরুত্বারোপ হয়ে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর উপযোগি শিখণ-শেখানো এবং
শিক্ষার্থীদেরকে উপযোগি করে তোলার জন্য দেশটি এ ধরণের পদ্ধতি প্রচলন ঘটিয়েছে। শিশু
শ্রেণি হতে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর পর্যন্ত এ শিক্ষা স্তর। অন্য অনেক দেশে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনৃসৃত কে-১২ শিক্ষা স্তর এবং ভাষা ও গণিত শিখনের উপর জোর
দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা গ্রহণ এবং শিক্ষা প্রদানের এ কৌশলটি অবলম্বন করা হলে
দেশে-বিদেশে একবিংশ শতাব্দীর শিখণ-শেখানোর মান অনেক বৃদ্ধি পাবে।
২৭.স্টার্ট-আপ
এডুকেশন: ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাগারবার্গ দম্পতি শিক্ষার
প্রসার এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ পদ্ধতি চালু করে। ধীরে ধীরে
এটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ফেসবুকের অনুসরণে অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ সংস্থা এবং
সংগঠনগুলোও এ ধরণের উদ্যোগ চালু করতে পারে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচিতে
দারুণভাবে উৎসাহিত হচ্ছে এবং পেরণা পাচ্ছে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয় পক্ষ এ
কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার এবং উন্নয়নে অবদান
রাখছে।
২৮.
মোবাইল শিখণ-শেখানো: মোবাইল ফোন ব্যবহার মানব জীবন-যাত্রায় বিশাল ও ব্যাপক
পরিবর্তন এবং প্রভাব বয়ে এনেছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর শিখণ-শেখানোতেও দারুন অবদান
রাখছে মোবাইল ব্যবহার। সর্বস্তরের মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে কল্প জগত বা বিনোদন
জগত পুরোটাই মোহাবিষ্ঠ হয়ে আছে। শিক্ষা জগতও এর বাইরে নয়। এ মোবাইল ব্যবহার হচ্ছে;
ভ্রমণ, কথা বলা, পড়াশোনা, বিনোদন, সবখানে। একটি মোবাইল অথবা লেপটপই বদলে দিতে পারে
শিক্ষা জগতকে। মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
২৯.
অদৃশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: দুনিয়াটাই শিক্ষা জগত। কোন
শিক্ষার্থী চাইলেই শিখতে পারে যে কোন অবস্থায়। তাহলে কোন শিক্ষার্থীকে বাক্সবন্ধী
করে রাখার কীই বা অছে? শুধু অন-লাইনে নয়, এ যুগের শিক্ষার্থীরা শিখবে, সবখানে।
তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে আঁটকে রাখার দরকার নেই। তারা শিখুক যেখানে ইচ্ছা।
৩০. আর্থিক স্বাবলম্বিতা: শিক্ষার্থীদেরকে আয় বর্ধক কাজে লাগিয়ে
শিখণে মনোযোগি করা যেতে পারে। আর্থিকভাবে দুর্বল শিশুদেরকে বিবিধ আয়-উপার্জনমূলক
কাজে নিয়োজিত করে উপার্জিত অর্থ তাদের কল্যাণেই ব্যবহার করার কৌশল অবলম্বন করে মানসম্মত
শিক্ষা এবং ব্যাপক শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব। সেইসাথে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার
পাশাপাশি কর্মমুখিও হয়ে ওঠে।
৩১. ভোকাশনাল প্রশিক্ষণ: দেশে দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ডিগ্রী নিয়ে কর্মমুখি সনদ
পাওয়ার জন্য আবার অন্য শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হয় বা সনদ যোগাড় করার চেষ্টা করে। একটি
চাকুরি পাওয়ার জন্যই তারা তা করে থাকে। কিন্তু কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষায় তা
করতে হয় না। বিশ্বব্যাপী এ ধরণের শিক্ষা বেশ সফল ও জনপ্রিয়। ছিন্নমূল, শ্রমজীবী,
বাস্তুহারা, দরিদ্র প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা অনেক
বেশি কার্যকর।
৩২.গেমিফিকেশন বা খেলার মাধ্যমে শিখণ: জনৈক ইংরেজ শিক্ষাবিদ শিখণ-শেখানোতে
খেলা-ধুলা সংযোজন করার কৌশলটি উদ্ভাবন করেন। সাধারণত: শিক্ষা গ্রহণে খেলার বিষয়টি
অনেকেই মেনে নিতে চাইবেন না। কিন্তু শিখনে এমন কিছু কিছু বিষয় আছে, যাতে খেলার
সমন্বয় ধারুণ উপকারিতা বয়ে আনে।
৩৩. স্মার্ট ক্যাপিটাল পদ্ধতি: সঠিক কাজে সঠিক অর্থ বিনিয়োগ করে
শিখন-শেখানোর কৌশল এটি। অর্থাৎ পড়াশোনা করার প্রয়োজনে কেউ যদি মোবাইল, লেপটপ,
কম্পিউটার বা অনুরূপ কিছু কিনে নেয় বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তবে তা ব্যর্থ হয় না।
এসব প্রযুক্তি কিনে শেখার কাজে ব্যবহার
করলে, সেটা কোন দিনই বিফলে যায় না। তাই স্মার্ট ক্যাপিটাল কৌশল অবলম্বন হতে পার
একবিংশ শতকের শিখন-শেখানোর অনণ্য পদ্ধতি।
৩৪. ক্যাটালিটিক রোল: মাইক্রোসফটের জনক বিল গেট্স এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের
মত সংস্থাগুলো আধুনিক সমাজে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তার এবং প্রসারে দারুণ ভূমিকা
রাখছে। এধরণের দাতব্য সংস্থাগুলো শিক্ষার্থীদেরকে আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত
সহায়তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রন্তিক-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অত্যাধনিক শিক্ষা
অর্জনে সফল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি তরুণ প্রযুক্তিবিদ এবং
তথ্য=প্রযুক্তি খাতে বিল গেটসেদের অবদান অবিস্মরণীয় রেখে বিশ্বব্যাপী সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ
শিক্ষা জগতকে আরও আলোকিত করে তুলতে পারেন।
৩৫. ব্লেন্ডেড লার্ণিং: শিখণ-শেখানোতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয় পক্ষ মুখোমুখি
উপস্থিত থাকেন এবং শিক্ষক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি বক্তব্য উপস্থাপন
করেন। সাথে প্রয়োজনীয় সকল শিখণ সামগ্রী এবং উপকরণাদি থাকে। কোন প্রযুক্তির সহায়তায়
আবার কোন সময় পাঠ উপস্থাপন চলে। এখানে মূলত কোনটার বিশেষ প্রাধান্য থাকে না।
শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে নির্দেশনা দেন মাত্র। আর শিক্ষিঅর্থীরা শিখে নেয়।
৩৬. কালেক্টিভ এডুকেশন বা সামষ্টিক শিখণ: এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা দলীয়ভাবে শিখে।
একাকী শিখনের চেয়ে শিক্ষার্থীরা একে অপরের থেকে শিখে এবং অধিকতর কার্যকরভাবে শিখে
এ পদ্ধতিতে। এটা এমন নয় যে, একাকী শিখে নেন তেমন কোন শিক্ষার্থীকে অেবহেলা করা হয়,
এটা বরং একই বিয়বস্তু সংঘবদ্ধভাবে শিখলে সকলের শিখনটা ভালভাবে হয়। কোন নির্দিষ্ট
বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে এক অপরের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা পাঠের শিখনফল অর্জন করে
নেয়।
৩৭. পার্সোনালাইজড এডুকেশন বা ব্যক্তিগত শিক্ষা: শিখনকে শিক্ষার্থী ব্যাক্তিগতভাবে গ্রহন
শিখে নেয়। এটা বেশ কার্যকর একটা পদ্ধতি। এতে ব্যক্তিগত শিখণে সামষ্টিক শিখন
অবহেলিত থাকেনা। এত শুধু ব্যক্তি চাহিদা এবং আকাংখা পূরণ হয়ে যায়। অর্থাৎ অনেকের
মধ্যে থেকেও একক শিখন অর্জিত হয়ে যায়।
৩৭. নমনীয় শিখণ: শিক্ষার্থী
যা শিখতে চায়, তা করতে দেয়া হলো নমনীয় শিখন। ব্যক্তিগত শিখনের সাথে নমনীয় শিখণকে
পরিচিত করে তোলা যায়। কোন বিশেষ বিষয় শিক্ষার্থী পছন্দানুযায়ি, স্বেচ্ছায় এবং
নিজস্ব উপায়ে শিখণেল প্রক্রিয়া বিশেষ এটি। একটা মান বজায় রেখে আমরা ব্যাক্তি বিশেষ
হিসেবে শিখন-শেখানো হওয়া উচিত নমনীয় প্রক্রিয়ায়।
৩৯. ফ্লিপ্ড লার্ণিং বা শিখনকে মুখ্য করে তোলা: একটি শ্রেণিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কোন নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ না থেকে শিখণ
অর্জনই প্রাধাণ্য পাবে এতে। শিক্ষক কী করছেন বা শিক্ষার্থীরাই কী করছে এমন অবস্থার
মধ্যে শিখণ ফল অর্জিত হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া এটি। এটা হতে পারে কোন ভিডিও
প্রদর্শণ বা কোন প্রবন্ধ আলোচনাকে কেন্দ্র করে। শিখণ-শেখানোর শেষটা ঘটে শিখণ ফল
অর্জন ক্রিয়ার সফল সমাপ্তির মাধ্যমে।
৪০. ক্লাসিক্যাল
এডুকেশন: এটা এমন এক মনোমুগ্ধকর শিখণ-শেখানো পদ্ধতি যেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের
উদ্দেশ্যে এমন কোন সিরিয়াস বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন যে, শিক্ষার্থীরা
ক্ষণকালের জন্য যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। হতে পারে তা শেক্শপিয়ার বা রবীন্ত্র নাথের
কোন উচ্চমার্গীয় সাহিত্য পাঠ। পাঠটি শিক্ষার্থীদেরকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যায় তারা
তার রস আস্বাধন করছে, কিন্তু তা দেখতে বা বুঝতে পারছেনা। কিন্তু আনন্দ উপভোগ করছে
এবং অনুধাবন করে যেতে পারছে, শিক্ষার্থীরা। ছোট্ট পরিসরে বা কম সংখ্যক শিক্ষার্থী
বিশিষ্ট শ্রেণি কক্ষে।
৪১. মাধ্যমিক
শিক্ষা উত্তর মুক্ত শিখণ: বিশ্বের অনেক দেশে মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ
শিক্ষার্থীদেরকে তারা পরবর্তী স্তরে পড়াশোনা করবে কি করবে না, তা তাদের জন্য
উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এ স্তরে তারা কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যায় অথবা শুধুই
পড়াশোনা করে। কিন্তু তাদেরকে উন্মুক্ত করে দেয়া হলে তাদের সুবিধা অনুযায়ি তারা
এগিয়ে যায়।
৪২. ধর্মীয়
শিক্ষা: ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে, কারণ সম্পদায় ও সংস্কৃতি বিশেষ অন্য বিষয়ে
জ্ঞানার্জনের বাইরে এটাকে তারা গুরুত্ব দেয়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তাদের
পারিবারিক এবং সম্প্রদায়গত সভ্যতাকে ধারণ করে নিতে আগ্রহী এবং পরিবর্তমান বিশ্বের
অসহিঞ্ষুতা ও সহিংসতা তাদেরকে আবর্তিত করে।
ফলে ধর্মীয় শিখণ বিষয়ও শিক্ষার এটি পদ্ধতি হতে পারে।
৪৩. নৈতিক
শিক্ষা: মানুষের আন্ত:কর্মে নৈতিক শিক্ষা অনেক ধর্মীয় এবং অনেক আধ্যাত্নিক
ভাবনা-চিন্তাকে ধারণ করে। তাই তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশমান ধারাকে আত্ত্বস্থ করে আমরা
পূর্বসূরিদের ভুল-শুদ্ধগুলোকে বেছে নেব এটাই আসল কথা। নৈতিক শিক্ষা এ ধরণের
পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহায়ক হয়।
৪৪. চারিত্রিক
শিক্ষা: নৈতিকতা সৃষ্টির পরিমন্ডলে চারিত্রিক শিক্ষার কথা আসে দ্বিতীয় স্তরে।
চরিত্র এমন কি শিক্ষার ক্ষেত্রে নৈতিকতার চেয়ে শক্তিশালী। শিক্ষার্থীদের
ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহিংসতা এবং যৌনতার
প্রতি এত দ্রুত আসক্তি বন্ধে চারিত্রিক উন্নয়ন কার্যকর ব্যবস্থা এবং সচেতনতা বয়ে
আনতে পারে। সকল স্তরের শিক্ষার্থীদেরকে চারিত্রিক শিক্ষা প্রদান হতে পারে অন্যতম
কৌশল।
৪৫. রেডিনেস
টেস্টিং: এ পদ্ধতি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদেরকে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালত করতে পারে।
এটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে সিদ্ধান্ত সহায়তা করে যে, শিক্ষার্থীরা একটি বিশেষ স্তরের
বিবিধ কাজ সম্পাদন করতে পারবে কিনা, অত:পর শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্নিকতা তাদেরকে
কোথায় এবং কোন দিকে এগুতে হবে তা নির্ধারণ করে দেয়।
৪৬. শেয়ারিং
ভয়েসেস: নিউজিল্যান্ডে শিক্ষার্থীদেরকে অন-লাইন ব্যবহার করে তাদের গল্প বলতে এবং
কন্টস্বর প্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। তাদের নিজ সম্প্রদায় এবং তাদের দেশে।
মুলত শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয় এবং নিজেদের শিখণের
দায়িত্ব গ্রহণ করে নেয়।
৪৭. দু:সাহসিক ভ্রমণের
মাধ্যমে শিখণ: শিক্ষার্থীদেরকে পর্বতারোহণ বা সমুদ্র ভ্রমণের অবাধ সুযোগ দেয়া হলে তারা
বাস্তব অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু শেখার সুযোগ পায়, যা হয়ত শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ্ থাকলে
সম্ভব হত না। এতে তাদের মনোবল ও বেঁচে থাকার শিক্ষা লাভ হয়।
৪৮. গ্লোবাল
ভিউ: চীনের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ইয়ং ঝোহা বর্তমানে অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপের
মাধ্যমে শিখণ-শেখানোতে খুব সাফল্য আসে না।
শিক্ষার্থীদেরকে সৃজনশীল হতে, উদ্যোক্তা হতে শেকানো সম্ভব হলে, তারা বিশ্ব কর্মী
হয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। তাঁর শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে বৈশ্বিকমন্ডলে উপযোগি
মানব সম্পদ গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। এতে তারাই ভাগ্য গড়ে নেবে, শিক্ষা তা করে
দেবে না।
উপসংহার: বর্তমান
জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং তথ্য-প্রযুক্তির অত্যাধুনিক ব্যবহার এবং বিকাশ; শিক্ষার ধারণা
এবং শিখণ-শেখানোর গতি-প্রকৃতিকে পুরোপুরি বদলে দেয়ার দারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
আগামীতে তা মানব জাতির শিক্ষা গ্রহণ এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিকে কোন পথে ধাবিত করবে তা
নিশ্চিত করে বলা যায় না। শিক্ষার্থীদেরকে বই বিমুখ এবং সিরিয়াস শিক্ষা গ্রহণ ও
পঠন-পাঠন হতে বিচ্যুত হতে দেখলেই বুঝা যায়, সনাতন শিক্ষা এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি আর
কাজে আসছে না। আমরা অন্য কিছুতে তা খুঁজছি। এমনই কিছু শিখণ-শেখানো পদ্ধতি এ
নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
*সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মহেশখালী, কক্সবাজার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন