শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭

Sir Syed Ahmad Khan

স্যার সৈয়দ আহমদ খান:
শিক্ষাবিদ, সংস্কারক ও দার্শনিক
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্*
স্যার সৈয়দ আহমদ ছিলেন, বৃটিশ শাসনামলে ভারতীয় মুসলমানদের অগ্রদূত। তিনি সৈয়দ আহমদ নামে বেশি পরিচিত। বৃটিশ-ভারতে উনবিংশ শতাব্দীতে অগ্রগন্য মুসলিম চিন্তাবিদ, সংস্কারক, দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ। আদালতে চাকুরি করতে করতে তিনি কুরআন এবং বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। পরে, তিনি বৃটেনের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। সৈয়দ আহমদ ১৮৩৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে চাকুরি নেন। আর ১৮৬৭ সালে তিনি বিচারক নিযুক্ত হন এবং ১৮৭৬ সালে চাকুরি হতে অবসর গ্রহণ করেন। ১৭৫৭ সালে বৃটিশরা ক্ষমতা দখল করার সময় তিনি বৃটিশ শাসনের প্রতি অনুগত থাকেন। তিনি মুসলমান সমাজের শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হন। সৈয়দ আহমদ খান পাশ্চাত্য ধারায়  আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে, সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশ এবং মুসলামানদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে  বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহন করেন। তিনি ১৮৫৯ সালে মুরাদাবাদে গুলশান স্কুল, ১৯৬৩ সালে গাজীপুরে ভিক্টোরিয়া স্কুল এবং ১৮৬৪ সালে মুসলমানদের জন্য সাইন্টিফিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৫ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান দক্ষিন এশিয়ার প্রথম মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ‘মোহাডোন এঙ্গলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ’ স্থাপন করেন। জীবদ্দশায় তিনি মুসলমানদের প্রতি বৃটিশ রাজের আনুগত্য বজায় রাখতে অত্যন্ত জোরালোভাবে আহবান জানান। সৈয়দ আহমদ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি পাকিস্তান-ভারতে মুসলমানদের মাঝে  প্রভাব গভীর সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। আর তাঁকে দ্বি-জাতি তত্ত্বের জনক মনে করা হয়। বিশেষত: পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর মুখ্য ভূমিকা ছিল। এ ক্ষেত্রে তিনি আল্লামা ইকবাল এবং জিন্নাহকে সক্রিয় সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন। ইসলামের যুক্তিবাদী ধারা অনুসরণ, উদারাবাদ চালুকরণ, কুরআনের সাথে বিজ্ঞান ও আধুনিকতার  গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন প্রভৃতি নিয়ে সৈয়দ আহমদ খানের ভাবনা-চিন্তা বিশ্বব্যাপী ইসলামী সংস্কার সাধনে ব্যাপক প্রভাব-বলয় সৃষ্টি করে।

সৈয়দ সৈয়দ আহমদের শৈশবকাল:
স্যার সৈয়দ আহমদ খান তৎকালিন মুগল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লীতে ১৮১৭ সালে ১৭ অক্টোবর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ সৌদি আরব হতে এসেছে বলে জানা যায়। মুগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে তাঁর পরিবার ভারতে আগমন করে। তখন হতে মুগল রাজ শাসনে তাঁর পরিবারের সদস্যগণ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তাঁর নানা খাজা ফরিদুদ্দিন ছিলেন, বাদশাহ আকবরের মন্ত্রী্। তাঁর দাদা সৈয়দ হাদী জওয়াদ বিন ইমামুদ্দিন বাদশাহ আলম গীরের সরকারে উচ্চ পদে সমাসীন ছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পিতা মোহাম্মদ বিন হাদী খান বাদশাহ আকবরের ব্যাক্তিগত বন্ধু ও উপদেষ্টা ছিলেন। তার শৈশব কাটে মুসলিম শাসনামলের অবসানকালে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং বৃটিশ শাসন যখন ভারত উপমহাদেশে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছিল, তখন স্যার ষৈয়দ আহমদ খান এবং তাঁর বড় ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ বিন মুত্তকী খান বেড়ে উঠছিলেন। তাঁর মা আজিজুন্নেসা কঠোর নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে তাঁদেরকে লালন-পালন করেন। তাঁদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দের বাবা-মা সর্বাত্নক আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। ছোট বেলায় স্যার সৈয়দকে কুরআন শিক্ষা দেয়া হয়। আর ভাল শিক্ষক দিয়ে উর্দু, ফার্সি, আরবী ভাষা এবং ধর্মীয় বিষয়গুলো তাঁকে পড়ানো হয়েছিল। স্যার সৈয়দ শাহাবী, রুমী ও গালিবসহ বিখ্যাত সব মুসলিম পন্ডিতদের কবিতা ও রচনাবলী অধ্যয়ন করেন। পাশাপাশি, তাঁকে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ইসলামী আইনশাস্ত্র বিষয়েও শিক্ষা দেয়া হয়। তাছাড়া, স্যার সৈয়দ শারিরীক কসরত, শরীর চর্চা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অংশ গ্রহণ করতেন এবং তিনি এসব কাজে চৌকশ ছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি হলেও, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তা সম্পন্ন করতে পারেন নি। ১৮৩৮ সালে তাঁর পিতার পরলোকগমনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি স্বচ্ছল মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বিশেষ আভিজাত্য নিয়ে কাটান। তাঁর আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলেও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাক্তিগতভাবে অধ্যয়ন ও চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। পরে তাঁর বড় ভাইয়ের সাথে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে আরম্ভ করেন। এসময় তিনি মুগল রোজ দরবারে কাজ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

কর্মজীবন:
ধীরে ধীরে মুগল রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে স্যার সৈয়দ আহমদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে একটি চাকুরিতে প্রবেশ করেন। তিনি বড় কোন পদে চাকুরির সুযোগ পান নি। কারণ সেসব পদ বৃটিশদের জন্য সীমিত ছিল। তাই তিনি আগ্রার আদালতে সেরেস্তাদার পদে যোগদান করেন। ১৮৪০ সালে তাঁকে মুন্সী পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ১৮৫৮ সালে তাঁকে মুরাদাবাদ আদালতে একটি উচ্চতর পদ দেয়া হয়। এ সময় তিনি তাঁর বিখ্যাত সব সাহিত্যকমৃ শুরু করেন। আদালতে কর্মকালিন সময়ে উপর মহলে সুসম্পর্ক থাকায়, স্যার সৈয়দ আহমদ বৃটিশ ঔপনিবেশিক রাজনীতি সমপর্কে নিবীড জ্ঞানার্জনের সুযোগ পান। ১৮৫৭ সালের ১০ মে, মুগল শাসনের অবসানকালে স্যার সৈয়দ আহমদ বিজনর আদালতে চীফ এ্যাসেসমেন্ট অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। মুগল সেনা বাহিনী এবং বৃটিশ বাহিনীর মধ্যে উত্তর ভারতে তীব্র লড়াই চলছিল। বিপুল সংখ্যক বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়। ক্ষমতার মূল মূল কেন্দ্র; যথা-দিল্লী, আগ্রা, লখনৌ এবং কানপুর মারাত্নকভাবে বিপর্যস্থ হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ নিজেও আহত হন। আর দীর্ঘ আটশ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। তিনি ও তাঁর সমসাময়িক মুসলমানগণ মুগলদের এ পতনকে মুসলিম সমাজের পরাজয় হিসেবে নেন। এসময় তাঁর বেশকজন নিকটাত্নীয়-স্বজন মৃত্যুবরণ করেন। আর তাঁর মাকে উত্থার করতে পারলেও, ঘটনা পরম্পরায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বেঙ্গলে নবাব আব্দূল লতিফ কতৃক ‘দ্যা মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে সামাজিক সংস্কার শুরু করেন। এসময় তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজটি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। তিনি অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং ভারতীয় মুসলিম সমাজে প্রচলিত কু-প্রবণতাসমূহ চরম অপছন্দ করতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানকে বরণ করে না নিলে মুলমানরা উন্নতি লাভ করতে পারবে না। কালক্রমে স্যার সৈয়দ আহমদ প্রগতিশীল আধুনিকতাকে গ্রহণ করা এবং ইসলাম ও খ্রিষ্টানদেরে মাঝে আন্ত:ধর্মীয় নিবীড সম্পর্ক স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের রচনাবলি:
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পড়াশোনা, অধ্যয়ন ও চর্চা ছিল ব্যাপক ও অত্যন্ত গভীর। তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ ছিল আইনে আকবরী নামক বিশাল গ্রন্থ রচনা, সম্পাদন এবং পরিমার্জন। গ্রন্থটি যেমন অত্যন্ত কঠিন এবং গবেষণামূলক। তিনি কাজটি শেষ করে তাঁর গুরু স্থানীয় প্রখ্যাত কবি মির্জা গালিব-এর তাঁর গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দেয়ার অনুরোধ জানান। বড় আশা-ভরসা নিয়ে মির্জা গালিবের কাছে গিয়ে স্যার সৈয়দ হতাশ হন। মির্জা গালিব ফারসী ভাষায় ছোট্ট একটি কবিতা লিখে দেন, আইন-ই-আকবরীর ভূমিকা না লিখে। স্যার সৈয়দ আহমদ ছোট্ট একটি পদে চাকুরি করলেও, তিনি ২৩ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন। এসময় তিনি প্রায় ৬০০০ পৃষ্ঠা রচনা করেন। তিনি মূলত: উর্দু ভাষায় লিখতেন। তিনি ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর লেখক জীবন শুরু হয়। তিনি মধ্যযুগ হতে দিল্লীর শাসন কাল পর্যন্ত সরকারি কার্যক্রমের দলিল-দস্তাবেজ সংকলন, সম্পাদন ও পরিমার্জন করে ১৮৪২ সালে ‘আসার-উস-সানাডিড’ নামে একটি রচনা করেন। এ গ্রন্থটি তাঁকে সংস্কৃতি বিষয়ক পন্ডিত হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। অত:পর তিনি, জিলা-উল-কুলুব বি জিক-রিল মাহবুব এবং তুহফা-ই-হাসান এবং তাহসিল ফি জার-ই-সাকিল নামে পর পর তিনটি বই লিখেন, ১৮৪৪ সালে। এসব বইয়ে তিনি ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি আলোচনা করেন। ১৮৫২ সালে, তিনি নামিকা দর বয়ান মাসালা তাসাউর-ই-শায়খ এবং সিলসিলাতুল-মুলক নামে আরও দুটি বই লিখেন। তিনি বাইলের ওপরও গ্রন্থ রচনা শুরু করেছিলেন। পরে তা আর শেষ করতে পারেন নি, তিনি। স্যার সৈয়দ আহমদ মহানবী (দ:) এর জীবনী নিয়ে অনেকগুলো ধারাবাহিক প্রবন্ধ রচনা করেন। ইতিহাস, রাজনীতি, পুরাতত্ত্ব, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, ধর্ম এবং বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর ব্যাপক পড়াশোনা এবং তিনি এসব বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারি ছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ ১৮৭৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৮৮৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

উপসংহার: সরকারি কোন দায়িত্বে থেকে বড় মাপের লেখক ও মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ কম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী; প্রভৃতি পেশার মানুষেরা যেভাবে উন্মুক্তভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারেন, চাকুরিজীবীগণ তা অনেক ক্ষেত্রে পারেন না। আবার লেখা-লেখির গুণগত এবং মানগত বিষয়ও দু‘শ্রেণির লেখকদের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণ করে দেয়। সরকারি দায়িত্বে থাকা লেখকগণ অন্দর মহলের মানুষ। তাঁরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত বিষয় এবং তথ্য ব্যবহার করেন। আর স্বাধীন লেখকগণ গবেষণা ও দ্বিতীয়-তৃতীয়সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্য তাঁদের লেখালেখিতে ব্যবহার করে থাকেন। দু‘পক্ষেরই কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছ। আর স্যার সৈয়দ আহমদ সরকারি দায়িত্বে থেকেই অনেকটা লেখা-লেখি করেছেন, তাঁর রচনাবলিতে সরকারি ভাষ্যের প্রবণতা পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি যে, বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষত: মুসলামানদেরকে আধুনিকতার পথ দেখানোর ক্ষেত্রে বোধহয় বৃটিশ-ভারতে স্যার সৈয়দ আহমদ অনন্য অবদান রেখে গেছেন।
*সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মহেশখালিী, কক্সবাজার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন