রবিবার, ২৫ জুন, ২০১৭

Creativity in Teaching


শিক্ষকতায় সৃজনশীলতা
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ 
  সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
                                             মহেশখালী, কক্সবাজার।
সৃজনশীলতা, শব্দটা শুনলেই অনেকের মনে হতে পারে, এটা গভীর কিছু, কঠিন কিছু বা সবার জন্য করা সম্ভব নয় এমন কিছু।আসলে কিন্তু, তা নয়। এটা আয়ত্ত্ব করার বিষয়, চর্চা করার বিষয় এবং নান্দনিক বোধ ও সৌন্দর্য্য প্রিয় মানুষের কাজ। এটা শিল্পকলা জাতীয় বিশেষ কোন ক্ষেত্রের জন্য নয়, শুধু। শিক্ষকতাসহ সব পেশায় সৃজনশীলতার বহি:প্রকাশ ঘটানো সম্ভব।আমরা এ নিবন্ধে বৃটিশ শিক্ষাবিদ স্যার ক্যান রবিনসন-এর সৃজনশীলতা বিষয়ক ভাবনার আলোকে শিক্ষতায় সৃজনশীলতা বিষয়ে আলোকপাত করব।
সৃজনশীলতা কী?
সৃজনশীলতা হলো, নতুন কিছু সৃজন করার জন্য দক্ষতা ও কল্পনার বহি:প্রকাশ ঘটানো। আমরা সাধারণত সৃজনশীলতা বলতে বুঝি এমন কোন কাজ, যাতে থাকে নতুনত্ব বা সৌন্দর্য্য। হোক না, তা লেখা-লেখি বা ছবি আঁকার কাজ, অথবা তা হতে পারে সাধারণ বা অস্বাভাবিক কিছু; ডাতে চিন্তার উদ্রেগ ঘটায় বা আনন্দ পাওয়া যায়, আমরা বলতে পারি তাই সৃজনশীলতা।আর, সৃজনশীলতা যদি হয়, শিক্ষকতার ক্ষেত্রে, তবে তা কী হতে পারে?যে শিক্ষকতায় সৌন্দর্য্য ফুটে ওঠে এবং শিক্ষার্থীদের শিখণ ফল ও বা যোগ্যতা অর্জন আনন্দদায়ক ও উত্তম হয়, তবেই বলতে পারি, তা সৃজনশীল।কারণ শিক্ষক নিত্যই কিছু না কিছু সৃষ্টি করেন, শ্রেণিকক্ষে, পাঠদানকালে।প্রতিদিনই তিনি সৃষ্টি করেন, সব সময় করেন।কিন্তু সৃজনশীল শিক্ষক বলতে কী সব শিক্ষককে বুঝাবে? হয়তো, না।এখানে একজন শিক্ষকের গল্প উল্লেখ করলে হয়ত সবাই বিষয়টি বুঝবেন।তিনি একজন ক্ষুদ্র জাতি সত্তার মানুষ।রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার বাসিন্দা, তিনি। এখন শিক্ষকতা হতে অবসরে চলে গেছেন। সে উপজেলায় কর্মরত থাকাকালে আমি তাঁকে সুদীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর ধরে দেখেছি। কর্মজীবনে সৃজনশীল শিক্ষক যাঁদেরকে পেয়েছি আমি, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।তাঁর নাম লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গা।সেখানকার লংগদুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তিনি।সেখান হতে অবসরে চলে যান, মি. লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গা।জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি বিপ্লবী রাজনীতি ও পার্বত্য রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পরে, ১৯৮০-এর দশকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। উপজেলার বিভিন্ন সুগম-দূর্গম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করে সবশেষে লংগদুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে তিনি অবসরে গেছেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ না পেলেও, বাবু লংগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গা, আমার বিবেচনায় একজন ভাল শিক্ষক। তাঁর প্রাথমিক স্তরের ইংরেজি, গণিতসহ সব বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান আছে। বিশেষ করে চারু-কারু ও সৃজনশীল কাজগুলোর জন্য সুদক্ষ একজন শিক্ষক, তিনি। পার্বত্য এলাকার মানুষের মধ্যে তিনি একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষক। তিনি কবিতা-ছড়া-গান প্রভৃতি রচনা, সুর দেয়া এবং আবৃত্তি প্রভৃতিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। তঙ্গা ভাষায়, তিনি বেশ কিছু লেখা-লেখি করেছেন।পাশাপাশি বাংলা ভাষায়ও তিনি ।নেক কিছু লিখেছেন। হয়তো পার্বত্য প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা হওয়ায়, তিনি জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় আসার সুযোগ পান নি।একীভূত শিক্ষা নিয়ে তাঁর রচনা করা একটি গান আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। আমার মনে হয়েছে, উন্নত মানের হয়েছে, এটি। সে উপজেলায় কর্মরত থাকাকালে আমি প্রায়ই তাঁর সঙ্গে বিবিধ বিষয়ে মতবিনিময়ে লিপ্ত হতাম।তিনি বিদ্যালয় পরিচালনা কাজে যেমন, সুচারু, দক্ষ ও নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন, তেমনি সৃজনশীলও। তিনি রীতিমত গায়ের পোশাক খুলে গেঞ্জি পরিধান করে শ্রমিকের মত হয়ে বিদ্যালয়ে কাজ করতেন। জাতীয় পতাকা উড্ডয়নের পতাকার স্ট্যান্ডটি তিনি নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন এমনভাবে যে, তা এখনও আমি ভুলতে পারি না।নিজ হাতে প্রত্যেক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চমৎকার ও আকর্ষণীয় সব শিক্ষা উপকরণ তৈরি করতেন ও অন্য শিক্ষকদেরও তা ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করতেন, সহায়তা করতেন। জেলা পর্যায়ে একবার শিক্ষা মেলায় তাঁর সহায়তায় আমি পুরস্কৃত হয়েছিলাম। তাঁর হাতে তৈরি করা বিভিন্ন আকর্ষণীয় উপকরণ ও অন্যান্য জিনিষ নিয়ে স্টল সাজিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম, আমরা।মেলার প্রত্যেকটা আইটেম তাঁর পরিকল্পনামত সাজানো হয়েছিল। যাহোক, শিক্ষকতাকে তিনি বেশ উপভোগ করতেন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগি অনেক জিনিষ নিজ বিদ্যালয়ে তৈরি করে ও সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। তিনি উপকরণ রাখার স্ট্যান্ড বানিয়ে ঝুলিয়ে ও দেয়ালে সেঁটে রেখেছিলেন। তাঁর বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৪০/৫০ জন মাত্র। তাঁর সহকর্মী ছিলেন মাত্র ২ জন। তিনিসহ তাঁর বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ৩ জন। তিনি প্রধান শিক্ষক, কিন্তু সব শ্রেণির সব বিষয়ের জন্য আকর্ষণীয় সব উপকরণ, পাঠপরিকল্পনা এবং উপকরণসমূহ যত্নসহকারে সাজিয়ে রাখতেন।ইংরেজি বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর ও বাঁকা হাতের অক্ষরগুলো তিনি চমৎকারভাবে লিখেন।তাঁর হাতের ছোঁয়ায় বিদ্যালয়ের সব জিনিষপত্র আকর্ষণীয় ও শিশুবান্ধব ছিল। পাহাড়ের টিলায় অবস্থিত তাঁর বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে তিনি একটি সুন্দর ফুলের ও ফলের বাগানে করেছিলেন। ২০১১ সালে তিনি অবসরপূর্ব ছুটিতে চলে যান।তিনি এত কর্মট ও সক্রিয় একজন মানুস ছিলেন যে, অবসরে নিয়েও তিনি অনেক সৃজনশীল কাজ করে এবং লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটান। জানা যায়, তিনি এখন কিছুটা শারিরীকভাবে অসুস্থ।তিনি বেঁচে থাকুন ও সুস্থ থাকুন। তাঁর একটু সমস্যা ছিল তিনি কানে কম শুনতেন।লিখছিলাম, শিক্ষকতায় সৃজনশীলতা নিয়ে।আর এ প্রসংগে আমার দেখা একজন সৃজনশীল শিক্ষক মি.লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গার কথা একটু প্রসংগক্রমে উল্লেখ করেছি।যাহোক, বৃটিশ শিক্ষাবিদ স্যার ক্যান রবিনসন বলেন,“সৃজনশীলতা হলো এমন এক প্রক্রিয়া যাতে মূল ধারণা নিহীত থাকে, যাতে অমূল্য কোন অর্থ থাকে।” স্যার রবিনসন, দীর্ঘদিন সৃজনশীলতা বিষয়ে কাজ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বৃটিশ সরকারের শিক্ষা বিভাগে জাতীয় পর্যায়েও কাজ করেছেন।তাঁর ভাবনাকে কেন্দ্র করেই বর্তমান নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে।তাঁর মতে সৃজনশীলতা বিষয়টি বুঝার জন্য আরও দুটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে;, সেগুলো হলো কল্পনা ও উদ্যম।কল্পনা সৃজনশীলতার মূল উৎস্। এটা এমন এক মনুষ্য সামর্থ্য, যা আমাদের মনে যে সব জিনিষ চলে আসে, আমাদের অনুভূতিতে তা বিরাজ করে না। সৃজনশীলতা হলো, কারও কল্পনাকে কাজে লাগানো। সৃজনশীলতা নিয়ে বহু মিথ বা কথা প্রচলিত আছে।শুধু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মানুষরাই সৃজনশীল হন, এমন একটি মমতামত অনেক ক্ষেতেই চলে আসে। আরেকটি মত হলো, সৃজনশীলতা শুধু শিল্পকলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।আর তৃতীয় মতটি হলো, সৃজনশীলতা শেখানোর কোন জিনিষ নয় এবং চতুর্থ মত হলো, সৃজনশীলতা এমন সব কিছু, যা অস্বাভাবিক কিছুর ‘আত্নপ্রকাশ’ বা আত্নবিকাশ কেন্দ্রিকতার প্রকাশ্য রূপ। স্যার রবিনসন আরও অভিমত দেন যে, উপরের ৪টি মতই সৃজনশীলতার সংজ্ঞায়নে শুধু প্রযোজ্য নয়। সৃজনশীলতা অনেক রকম শক্তির বহিপ্রকাশ, যা মানব সত্তা হিসেবে সহজাতভাবে আমাদের মাঝে বিরাজ করে থাকে। সৃজনশীলতা সম্ভব মানব জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে; বিজ্ঞান, শিল্পকলা, মানব বিদ্যা, গণিত, প্রযুক্তি, রন্ধন শিল্প, শিক্ষকতা, রাজনীতি, ব্যবসায় ইত্যাদিতে।আর অন্য অনেক মানব ক্ষমতার ন্যায় আমাদের সৃজনশীলতার শক্তিও চর্চা ও সমৃদ্ধ হওয়ার ব্যাপার। আর তাতে জড়িত রয়েছে, দক্ষতা, জ্ঞান এবং ধারণাকে উন্নতকরণের বিষয়টি।সৃজনশীলতা হলো, নব নব ভানা। তবে, সম্পূর্ণরূপে অন্যরকম হতে হবে, তা কিন্তু নয়, যদিও তা বিশেষ একটা গুণ। সৃজনশীলতায় থাকতে হবে ন্যায়বোধ, কোনটা মন্দ, কোনটা ভাল; তা বুঝতে পারতে হবে। সেটা হতে পারে, তাত্ত্বিক কোন বিষয়, নকশাকরণ অথবা একটি কবিতা রচনা। সৃজনশীলতার কাজ সম্পাদনে সব সময় কঠিন সব পর্যায় অতিক্রম করতে হয়।মাঝে মাঝে এমনও হয় যে, কেহ কী করেছেন, তা মুখ্য হয় না, মুখ্য হয়ে যায় কাজটি শুরু করার সময় মনে কী ছিল তাই।এটা গতিশীলতার সাথে সংশ্লিষ্ট, যা অনেক সময় নতুন সংযোগ, শৃংখলাকে অতিক্রমণ এবং রূপক কিছু ও কোন কিছুর প্রতিচ্ছায়াকে পকাশ করে।সৃজনশীল হওয়া মানে শুধু দেয়ালের আড়ালের কিছু নিয়ে ভাবা নয় এবং কাউকে কল্প জগতে ভাসানোও নয়।সেগুলোসহ অরও কিছু। যেমন-সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলা, নিরীক্ষণ করা ও নিজের কাজকে দৃশ্যমান করে তোলা।এটা ব্যক্তির প্রকৃত সৃজন ভাবনার অঙ্গ। আবার কারও চলমান কাজের মান নিয়ে নিরীক্ষাকরণ, কাজটি সঠিকভাবে এগুচ্ছে কিনা এবং যথাযথ হচ্ছে কিনা তা দেখা, অন্য কথায়, যে কোন কাজে সৃজনশীলতায় গভীর তথ্যবহুল জ্ঞান এবং উচ্চতর দক্ষতার অনুশীলণ প্রয়োজন হয়। যে কোন শিক্ষকের জন্য সৃষ্টিশীলতা বিষয়টি অন্যতম আনন্দদায়ক ঝুঁকি নেয়ার মত। সৃজনশীল কাজের প্রকৃত রূপ বুঝতে পারার সাথে এটি সংশ্লিষ্ট। সৃজনশীলতা কোন বিশেষ একটি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া নয়, যাতে কাউকে চর্চার আগেই প্রয়োজনীয় সকল দক্ষতা অর্জন করে নিতে হয়। এটা সত্য যে, যে কোন ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজ, একটি ক্রমবর্ধমান দক্ষতা ও ধারণাকে সম্পৃক্ত করে।তবে তা এমন নয় যে, কাজ আরম্ভের পূর্বেই কাজটিতে একেবার পটু হতে হবে। একাকীত্বের দক্ষতাকে দৃষ্টিপাত করা  হলে, কেহ যে কোন কিছুর আগ্রহকে মেরে ফেলতে পারে। অনেকে গণিত শাস্ত্রকে গলাদকরণ  বা মুখস্থ করে নেয়, তাতে সংখ্যার সৌন্দর্য্য ফুটে ওঠে না। সত্যিকার সৃজনশীল মানুষদের ক্ষমতা হলো, নতুন কিছু ভাবা এবং কাজের প্রতি মমতা প্রদর্শন করা। শিক্ষার্থীরা যখন কোন কিছু শিখনে উদ্বুদ্ধ হয় হয়, তবে এমনিতেই তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জিত হয়ে যায়। তাদের দক্ষ হয়ে ওঠার ধারাই তাদেরকে সৃজনশীল উচ্চাকাংখাকে অর্জন করিয়ে দেয়। ফুটবল খেলা হতে রসায়ন শাস্ত্রের নিরস কোন বিষয়েও শিক্ষকগণ শিক্ষকতায় সৃজনশীলতার বহি:প্রকাশ ঘটাতে পারেন।

উপরে, আমার দেখা একজন সৃজনশীল শিক্ষকের দৃষ্টান্ত উল্লেখপূর্বক শিক্ষকতায় সৃজনশীলতার বিষয়টি আলোকপাত করা হলো। আর মূল ধারণাটি তুলে ধরা হলো, বৃটিশ শিক্ষাবিদ স্যার ক্যান রবিনসন-এর নিবন্ধ “শিক্ষকতায় সৃজনশীলতা”-এর আলোকে।যাহোক, শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করছি, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। শিক্ষকগণ সৃষ্টি, সৃজনশীলতা, শব্দগুলোর সাথে সুপরিচিত। আশা করব, প্রত্যেক শিক্ষকই হবেন, শিক্ষাদানে বা শিখণ-শেখানোতে দক্ষ, উত্তম, সৃজনশীল ও আদর্শ স্থানীয়।    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন