কন্স্ট্রাক্টিভিজম একটি শিখন তত্ত্ব:
বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
মানব
শিশুর শিখন-শেখানো পদ্ধতি এবং শিক্ষা গ্রহন নিয়ে অনেক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। এখনও,
এনিয়ে নতুন নতুন সব ভাবনা উদ্ভাবন করা হচ্ছে।বিশেষত তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে
শিক্ষাদান এবং শিক্ষা গ্রহণের নতুন ভাবনা ও প্রায়োগিক প্রেক্ষাপটে কোন্ শিখণ
তত্ত্বটি বেশি সহায়ক, এসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।কন্স্ট্রাক্টিভিজম এমন একটি
নতুন ভাবনা।এটি একটি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখণ-শেখানো পদ্ধতি। এনিবন্ধে
কন্স্ট্রাক্টিভিজম শিখণ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে।জ্যাক্যুলিন গ্রেনম্যান ব্রুকস
নামক একজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী বলেন,“মানুষ যখন থেকে এক অপরকে প্রশ্ন করে কোন কিছু
জানার জন্য চেষ্টা করে আসছে, তখন হতে কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শ্রেণিকক্ষের সূচনা
ঘটেছে। কন্স্ট্রাক্টিভিজম হলো, শিখণের ওপর সমীক্ষা পরিচালনা করা, কীভাবে আমরা
আমাদের জগতকে অনুভব করি এবং যা সত্যিই পরিবর্তন হয়নি।” এ ধারণাটি সক্রেটিসের
অনুসারিদের সাথে সংলাপ করার প্রক্রিয়া হতে উৎসারিত।অনুসারিদের প্রশ্নে কোথায়
চিন্তন দুর্বলতা প্রকাশ পেত, তা সক্রেটিস শুধরে দিতেন। কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট
শিক্ষাবিদগণ, সক্রেটিসের এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের শিখণ মূল্যায়ন এবং নতুন বিষয়ে
শিখণ অভিজ্ঞতার ব্যাপারে পরিকল্পনা তৈরির জন্য অনেক খোরাক খুঁজে পান। এক বিংশ
শতাব্দীতে জাঁ পিঁয়াজে এবং জন ডিউই শিশু শিখণ এবং শিক্ষা গ্রহণ বিষয়ে প্রগতিশীল
ভাবনার উদ্রেক ঘটিয়েছেন এবং কনস্ট্রক্টিভিজমকে বিকশিত করেছেন। নিন্মের আলোচনাটি
মূলত উল্লেখিত শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী জ্যাক্যুলিন গ্রেনম্যান ব্রুকসের একটি সেমিনার
পেপারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
কন্স্ট্রাক্টিভিজম কী?
কন্স্ট্রাক্টিভিজম
মূলত: এমন এক শিখণ তত্ত্ব, যাতে মানব শিশু কীভাবে শিখে তা পর্যবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক
সমীক্ষা ভিত্তিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়। এর বালা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়
কাটামোবদ্ধকরণবাদ।এ তত্ত্ব অনুযায়ি মানুষ তাদের নিজস্ব বোধগম্যতা ও পৃথিবীর জ্ঞান
অর্জন করে থাকে, কোন জিনিষের অভিজ্ঞতা এবং সেসব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটানোর মধ্য
দিয়ে।আমরা যখন কোন কিছুকে মোকাবেলা করি, হতে পারে, আমাদের বিশ্বাসে পরিবর্তন ঘটাবে
তা, অথবা অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে নতুন তথ্য অপরিহার্য হবে।উভয় ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের
নিজস্ব জ্ঞানের সক্রিয় স্রস্টা। এটা করতে হলে, আমাদেরকে অবশ্যই প্রশ্ন জিজ্ঞেস
করতে হবে, অনুসন্ধান করতে হবে এবং আমরা যা জানি তা মূল্যায়ন করতে হবে।
কন্স্ট্রাক্টিভিজম
শিখণ অভিমত অনুযায়ি শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন শিখণ-শেখানো অনুশীলণ করা হয়।অধিকাংশ
ক্ষেত্রে এটা বুঝানো হয় যে, অধিক জ্ঞান সৃস্টি এবং তার প্রফিলন ঘটে ও তারা যা করছে
এবং তাদের বোধগম্যতায় পরিবর্তন ঘটছে, তা কথা বলা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদেরকে সক্রিয়
কৌশল প্রয়োগে উৎসাহিত করা। শিক্ষক নিশ্চিত করেন যে, তিনি শিক্ষার্থীদের পূর্ব
ধারণা সম্পর্কে বুঝেন এবং সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে ও তার ওপর অবিচল
থাকতে নির্দেশনা দেন। কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শিক্ষকগণকে, শিক্ষার্থীরা তাদের শিখনে
কতটা সক্রিয় তা নিত্যই মূল্যায়ন করতে হবে।শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে প্রশ্ন করে ও
তাদের নিজস্ব কৌশল অনুসরণ করে দক্ষ শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে।এ প্রক্রিয়া তাদের শিখণকে
অব্যাহত রাখতে অনুপ্রাণিত করে থাকে। একটি সুপরিকল্পিত শ্রেণি পরিবেশে শিক্ষার্থীরা
কীভাবে শিখতে হয়, তা মেনে নেয়। এটাকে মনে হতে পারে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা একটা
বোধগম্যতা কাঠামো। এটা যখন অব্যাহতভাবে তাদের অভিজ্ঞতায় পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষর্থীরা
তাদের ধারণাগুলোকে জটিলতা ও শক্তি লাভ করতে দেখতে পায় এবং নতুন নতুন তথ্যক সুদৃঢ়
ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা দিতে ক্রমান্বয়ে শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করে। এতে শিক্ষকদের
একটি প্রধান ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায়, শিখণে ও শিখণ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন প্রক্রিয়ায়
উৎসাহিত করা।দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, বিজ্ঞান বিষয়ক একটি শ্রেণি
পাঠদানে একদল শিক্ষার্থী পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ক সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত
রয়েছে।শিক্ষক যদিও সমস্যাটির সমাধান জানেন, কিন্তু তিনি শিক্ষার্থীদেরকে দিয়েই
সমাধানটি বের করে নেন। তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তাদের নিজ নিজ শিখণের প্রতিফলন
এবং নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের বর্তমান জ্ঞানের আলোকে।যখনই একজন শিক্ষার্থী প্রাসংগিক
কোন প্রশ্ন উত্থাপন করবে, শিক্ষক তা গ্রহণ করবেন এবং দলীয় কাজে নিয়োজিত
শিক্ষার্থীদেরকে জানাবেন। প্রশ্নটি তাদের সমস্যার সমাধান পেতে সহায়ক হবে। তারা
এটাকে সূত্র হিসেবে নিয়ে প্রাসংগিক পরীক্ষা চালাবে। অতপর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা
তাদের শিখণ ফল নিয়ে পর্যালোচনা করবে এবং তাদের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে;
সমস্যা বা ধারণাটি বুঝতে কতটা সহায়ক হয়।
কনস্ট্রাক্টিভিজম-এর সমালোচনা: কনস্ট্রাক্টিভিজম-এর
সমালোচকগণ বলেন যে, এতে শিক্ষকের সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং অথবা বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের
অবদানকে নাকচ করা হয় না, বরং কাঠামোবদ্ধকরণ তত্ত্বে শিক্ষকের ভূমিকাকে সুদৃঢ় করা
হয়, যাতে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেয়ে তাদের জ্ঞানকে
কাঠামোবদ্ধ রূপ দেয়। কাঠামোবাদী শিক্ষকগণ, সমস্যা-সমাধানমূলক এবং অনুসন্ধানমূলক
শিখণ-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে, পরিসমাপ্তিতে
হস্তক্ষেপ বয়ে আনে।আর সব মিলে একটি সহযোগিতামূলক শিখণ পরিবেশ সৃস্টি করে দেয়।
কাঠামোবদ্ধকরণ শিক্ষার্থীদেরকে শিখণ প্রক্রিয়ায় পরোক্ষ শিখণ হতে প্রত্যক্ষ শিখণে
সক্রিয় করে তোলে। শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নিকট হতে
পাঠ্যবই থেকে সনাতন জ্ঞান অর্জন করার চেয়ে তাদের জ্ঞানকে গঠন করে নেয়।
কাঠামোবদ্ধকরণ মতবাদকে শিখণ তত্ত্ব হিসেবে প্রায়ই ভূল ধারণা পোষণ করা হয় যে, এতে
শিক্ষার্থীদেকে একই বৃত্তে ঘুরপাক খেতে হয়। বস্তুত কাঠামোবদ্ধকরণ শিক্ষার্থীদের বিশ্ব
জগৎ এবং এর কার্যক্রম সম্পর্কে অনুসন্ধানে ও অন্তর্নিহীত শক্তিকে কাজে লাগাতে
উৎসহিত করে। শিক্ষার্থীদের একই বৃত্তে আবদ্ধ রাখা হয় না, এতে তাদের বোধগম্যতা
বৃদ্ধি পায় ও কার্যকর শিখণ চলে। তারা তাদের বর্তমান জ্ঞান এবং বাস্তব জীবনের
অভিজ্ঞতা, শিখণকে কল্পনায় রূপদান, তাদের তত্ত্বকে যাচাইকরণ করে এবং তাদের
অনুসন্ধান হতে প্রাপ্ত বিষয়গুলোকে কাজে লাগিয়ে শিখনে নিয়োজিত হয়।
কন্স্ট্রক্টিভিজম ও সনাতন শিখণ তত্ত্বের
মধ্যকার পার্থক্য: এ তত্ত্বের মূল
কথা হলো; শ্রেণিকক্ষে শিখণ-শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষক-কেন্দ্রীয় চরিত্র না হয়ে,
শিক্ষার্থীরাই কেন্দ্রেবিন্দু হবে। শ্রেণিকক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীরা আর কর্মবাচ্য
হবে না, তারাই হবে কর্তৃবাচ্য বা কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষকগণ জ্ঞান বিতরণ
করবেন, শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করবেন, তা আর হবে না। এ তত্ত্বে শিক্ষার্থীদেরকে তাদের
শিখণে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত হতে বলা হবে। শিক্ষক কাজ করবেন, সহায়ক হিসেবে,
মধ্যস্থাকারি হিসেবে, পরামর্শ দেবেন এবং শিক্ষার্থীদেরকে শিখণ ফল বুঝতে ও প্রয়োগ
করতে সহায়তা দেবেন এবং শিক্ষার্থীরা শিখবে।শিক্ষকের অন্যতম কাজ হবে,
শিক্ষার্থীদেরকে ভাল ভাল প্রশ্ন করে শিখণকে ফলপ্রসূ রূপদান করা। আর
কাঠামোবদ্ধকরণবাদে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ে জ্ঞান নিয়ে চিন্তা করবে,
মুখস্থ করবে না, বরং একজন গতিশীল শিক্ষার্থী হবে, পৃথিবীকে পাল্টে দেয়ার কথা ভাববে
এবং অর্জিত জ্ঞানকে সফলভাবে বিস্তরণ করবে ও তা অনুসন্ধান করে যাবে। নিন্মে
শ্রেণিকক্ষে শিখণ-শেখানো কার্যক্রম সম্পর্কে সনাতন পদ্ধতি ও কন্স্ট্রক্টিভিস্ট
তত্ত্বের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো। জ্ঞান, শিক্ষার্থী ও শিখণ-শেখাণোর
মাঝে এতে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট তত্ত্বে
শিক্ষার্থীরা গুরুত্ব পায়, শিক্ষক নন।
সনাতন শ্রেণিকক্ষ
|
কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শ্রেণিকক্ষ
|
-শিক্ষাক্রম আরম্ভ হয়,
সমগ্রকের অংশ বিশেষ দিয়ে। মৌলিক দক্ষতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
-নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রমকে
গুরুত্ব দেয়া হয় এবং এর ওপর অবিচল থাকা হয়।
-প্রাথমিকভাবে উপকরণ
হিসেবে ব্যবহৃত হয়, পাঠ্যবই ও খাতাপত্র।
-পুণরাবৃত্তি ভিত্তিক
শিখণ-শেখাণো কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
-শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে
তথ্য দেন, শিক্ষার্থীরা হয় জ্ঞান অর্জনকারি।
-শিক্ষকদের ভূমিকা থাকে
নির্দেশনামূলক, কতৃত্ববোধ থেকে উৎসারিত।
-মূল্যায়ন করা হয়,
পরীক্ষার মাধ্যমে।
-জ্ঞানকে স্থির বা অবিচল
গণ্য করা হয়।
-শিক্ষার্থীরা প্রধানতঃ
একাকী কাজ করে।
|
- শিক্ষাক্রমকে বৃহত ধারণা
হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়, সমগ্রক দিয়ে শুরু হয় না এবং অংশ বিশেষকে বিস্তরণের
অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
-শিক্ষার্থীদেরকে
প্রশ্নকরণ এবং তাদের আগ্রহকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
-উপকরণের প্রাথমিক উৎস এবং
মূল উপকরণও উপরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
-শিখণ-শেখানো চলে
আন্তক্রিয়া ভিত্তিক; শিক্ষার্থীরা এর মধ্যে যা শিখেছে, তার ওপর ভিত্তি করে।
-শিক্ষকগণ, শিক্ষার্থীদের
সাথে সংলাপে লিপ্ত হন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের জ্ঞানকে কাঠামোগত রূপ দিতে
শিক্ষকদের সহায়তা নেয়।
-শিক্ষকের ভূমিকা থাকে
আন্তক্রিয়ামূলক, ভিত্তি থাকে আলোচনা-সমালোচনামূলক।
-শিক্ষার্থীদের কাজ,
পর্যবেক্ষণ এবং তাদের মতামত ও পরীক্ষা বা মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত থাকে। শিখণফল
অর্জনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াও গুরুত্ব পায়।
-জ্ঞানকে গতিশীল অভিজ্ঞতার
সাথে পরিবর্তমান মনে করা হয়।
-শিক্ষার্থীরা প্রধানত
দলীয়ভাবে কাজ করে।
|
শ্রেণিকক্ষে কন্স্ট্রাক্টিভিজম-এর ভূমিকা: হতে পারে বর্তমানে ব্যবহৃত বা জনপ্রিয় অনেক কৌশল
শ্রেণি শিখণ-শেখানোতে প্রয়োগ হচ্ছে, যা অনেকটা কন্স্ট্রাক্টিভিজমের সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাঠামোবদ্দকরণ তত্ত্বে শিক্ষকগণ প্রশ্ন করেন এবং সমস্যা তুলে ধরেণ।
অতপর শিক্ষার্থীদেরকে তাদের নিজেদের উত্তর বা সমাধান পেতে সহায়তা করে থাকেন।
শিক্ষাদান বা পাঠদান প্রক্রিয়ায় তাঁরা অনেক কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। যেমন-হতে পারে
তাঁরা নি্ন্মোক্ত প্রক্রিয়া মেনে চলেন।
-শিক্ষার্থীদেরকে তাদের নিজস্ব
প্রশ্ন বা অনুসন্ধান পন্থা বের করে নিতে বলেন।
-শিখণ-শেখানো চলাকালে
বিষয়বস্তু বা শিখণফলের বহুমুখি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার সুযোগ করে দেয়া হয়।
-দলীয় কাজে উৎসাহিত করা হয়
এবং সহযোগিতামূলক শিখণ-শেখানো পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া হয়।
কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শ্রেণিকক্ষ্যর শিখণ-শেখঅনো
বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১.কন্স্ট্রাক্টেড বা কাঠামোবদ্ধ হবে: শিক্ষার্থীরা খালিপাত্রের ন্যায় হবে না, যাতে জ্ঞান
বিতরণ করে ভর্তি করে দেয়া হবে। তারা ইতোমধ্যে অর্জিত জ্ঞান, ধারণা ও বোধগম্যতা
নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে থাকে। তাদের পূর্ব জ্ঞান নতুন জ্ঞান সৃস্টিতে কাঁচা
মালের ন্যায়। যেমন-একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রেণিতে একটি সমস্যা উপস্থাপন
করে কোন ফুলের রং চিহ্নিত করতে বা দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে দেবেন। তিনি নিজে ধারণা না
দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে সুযোগ করে দেবেন। এবং নিজস্ব উপায়ে
সমস্যা সমাধান করতে দেবেন। কোন শিক্ষার্থী একাশ করবে যে, ডাক্তার বলেছে, সে ৪ ফুট
দীর্ঘ। অন্যজন বলবে, ঘোড়াকে হাত দিয়ে মাপা হয়। শিক্ষার্থীরা এভাবে তাদের জানা বা
শোনা অন্যান্য পদ্ধতিগুলো প্রকাশ করবে। আর শিক্ষেকের উত্থাপিত প্রশ্নটি সমাধানে
সিদ্ধান্ত নিবে।
২.এক্টিভ বাসক্রিয় খাকা: শিক্ষার্থীরা এমন হবে যে, যারা নিজেরাই নিজেদের নতুন
নতুন বোধগম্যতা সুজন করে নেবে। শিক্ষক পশিক্ষণ দেন, সংশোধন করেন, পরামর্শ দেন, কিন্তু
শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা করতে, প্রশ্ন করতে, চেষ্টা করেন, পারেন না, এমন সব কাজ করতে
শিক্ষকগণ সুযোগ করে দেন। শিখণ-শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি অংশগ্রহণ
প্রয়োজন হয়। শিখণ প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্তপূর্ণ অংশ হলো, তাদের কার্যক্রমের
প্রতিফলন ঘটানো ও কথা বলা। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই মূল্যায়নের উদ্দেশ্য ও উপায় ঠিক
করে নেয়।
৩.প্রতিফলণমূলক: শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেদের শিখণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, এবং
তারা তা করে তাদের অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে এগিয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা এমন
পরিস্থিতি সৃস্টি করতে সহায়তা করে থাকে, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রশ্নকরণে নিরাপত্তা
বোধ করে এবং তাদের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন ঘটায়; এককভাবে ও দলীয়ভাবে। শিক্ষকেরও
উচিত এমন কার্যক্রম সৃজন করা, যা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের পূর্বজ্ঞান ও অভিজ্ঞতায়
প্রতিফলন ঘটায়।শিক্ষার্থীদের শিখণ নিয়ে আলোচনা করা এবং তা তারা কীভাবে শিখেছে সেটা
সত্যিকার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ।
৪.কোলাবোরেটিভ বা সহযোগিতামূলক পরিস্থিতি: কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট
শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সহযোগিতামূলক মনোভাবের ওপর ভিত্তিশীল।সহযোগিতামূলক
মনোভাব শিখনে ভূমিকা পালনের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট পদ্ধতিতে
এটার ব্যবহারের প্রধান কারণ হলো, এখানে শিক্ষার্থীরা যখন পর্যালোচনা করে এবং শিখণ
প্রকিয়ায় একত্রে তার প্রতিফলন ঘটায়, তাদের কৌশল এবং পদ্দতি একে অপরের সহায়তায় বের
করে নিতে পারে।
৫.ইন্কুয়ারি বা অনুসন্ধানমূলক শিখণ: কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শিখণ কার্যক্রমে
প্রধান লক্ষ্য হবে, সমস্যা সমাধান করা। শিক্ষার্থীরা অনুসন্ধান পদ্ধতি প্রয়োগ করে
থাকে প্রশ্ন করতে, কোন বিষয়বস্তু তদন্ত করতে এবং কোন সমস্যার সমাধান ও উত্তর পেতে
বিবিধ উপকরণ প্রয়োগ করে থাকে। শিক্ষার্থীরা যেহেতু বিষয়বস্তু বা শিখণ অনুসন্ধান
করে, তারা সিদ্ধান্তে উপণীত হয়, আর যেহেতু অনুসন্ধান অব্যাহত থাকে, তার প্রাপ্ত
সমাধানগুলো আবার পুণরালোচনার সুযোগ আসে। প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গিয়ে এতে অধিক
প্রশ্নের উদ্রেক হয় এবং আরও শিখণ হয়।
৬.ইভল্বিং বা শিখণকে সুদৃঢ়করণ: নতুন অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করার সময়, শিক্ষার্থীদের
এমন ধারণা হতে পারে যে, যা শিখেছে তা অকার্যকর, অশুদ্ধ বা অপর্যাপ্ত। জ্ঞানকে
সমন্বয় করতে এসব ধারণা অস্থায়ী পদক্ষেপ। দৃস্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, একটি
শিশু বিশ্বাস করতে পারে যে, সকল বৃক্ষের পাতা শীতকালে ঝরে পড়ে। যতক্ষণ না, সে দেখে
পত্র-পলল্লবে চির সবুজ অন্য একটি বৃক্ষ। কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শিক্ষকগণকে
শিক্ষার্থীদের বিদ্যমান ধারণাকে ও জ্ঞানের ভিত্তিতে তা বিবেচনায় নেয়া হয়।
কোন শিক্ষার্থী নতুন তথ্য পেলে কী ঘটে? কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট তত্ত্বে বলা হয় যে, শিক্ষার্থী
প্রাপ্ত তথ্যকে ইতোমধ্যে অর্জিত জ্ঞান ও বোধগম্যতার সাথে তুলনা করে নেবে। আর এতে
নিন্মের পরিস্থিতির যে কোনটা ঘটতে পারে।
-নতুন তথ্য তার পূর্বে
অর্জিত জ্ঞানের সাথে বেশ সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ হতে পারে। তাই শিক্ষার্থী তার
বোধগম্যতায় তা সংযুক্ত করে নিতে পারে। এতে আরও কাজের প্রয়োজন হতে পারে।
-নতুন প্রাপ্ত তথ্যটি তার
পূর্বজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। শিক্ষার্থী তার পূর্ব বোধগম্যতাকে
পরিহার করে নতুনটি প্রয়োগ করে নিতে পারে।
একাজটি কঠিনতম হতে পারে।
-নতুন তথ্যটি পূর্বজ্ঞানের
সাথে নাও মিলে যেতে পারে এবং অবহেলিত হতে পারে। কিছুটা সংশোধন করে নিয়ে শিক্ষার্থী
তা গ্রহণ নাও করতে পারে। অথবা সে তথ্যটি পাশেই থাকতে পারে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থী তা
পরে গ্রহণ করতেও পারে।
কনস্ট্রাক্টিজম বা কাঠামোবদ্ধকরণ তত্ত্বের
উপকারিতাসমূহ:
-শিশুরা অনেক বেশি শিখে এবং
তারা সক্রিয়ভাবে শিখণ-শেখানোতে লিপ্ত হয় বিধায় শিখণকে অধিক উপভোগ করে থাকে, যা
তারা পরোক্ষ শিখণে পারে না।
-শিখণ তখনই সবচেয়ে ভাল হয়,
যখন এতে চিন্তন ও বোধগম্যতার ওপর মনোনিবেশ করা হয়। কন্সট্রাক্টিভিজমে কীভাবে
চিন্তা করতে হয় ও বোধগম্যতা অর্জন করতে হয়, তা শিখনের ওপর মনোনিবেশ করে।
-কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শিখণ
স্থানান্তরযোগ্য। কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত নীতিমালা
সৃজন করে থাকে, যা তাদেরকে অন্যান্য শিখণ ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যায়।
-কন্স্ট্রাক্টিজিম
শিক্ষার্থীদেরকে তাদের শিখনের মালিকানাবোধ জাগ্রত করে। যেহেতু শিখণ শিক্ষার্থীদের প্রশ্নমালা
ও অনুসন্ধান এবং প্রায়ই শিক্ষার্থীরা মূল্যায়নেও ভূমিকা পালন করে থাকে। কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট
মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদেরকে উদ্যোগ গ্রহণে নিয়োজিত করে থাকে এবং তাদের জার্ণাল
তৈরি, গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি, দৈহিক মডেল তৈরি এবং উপস্থাপনে ব্যক্তিগতভাবে
নিয়োজিত করা হয় এবং তাদের শৈল্পিক প্রতিনিধিত্ব করে। শিক্ষার্থীরা সহজাত
সৃস্টিশীলতা নিয়ে বিবিধ উপায়ে তাদের অর্জিত জ্ঞান প্রকাশে তাদের সামর্থ্যের
বহিপ্রকাশ ঘটায়।
-একটি নির্ভরযোগ্য,
বাস্তবভিত্তিক বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কনস্ট্রাক্টিভিস্ট শিক্ষার্থীদেরকে একাত্ন করে
এবং কার্যক্রমে নিয়োজিত করে। কনস্ট্রাক্টিভিস্ট শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা কোন
বিষয়ে প্রশ্ন করতে এবং বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাতে শিখে।
-কন্সট্রাক্টিভিজম তত্ত্ব
শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশ ঘটায়, এমন এক শ্রেণিকক্ষ পরিবেশ
সৃস্টি করার মাধ্যমে যাতে সহযোগিতামূলক মনোভাব ও ধারণা বিনিময়ের ওপর জোর দিয়ে
থাকে। শিক্ষপার্থীদের অবশ্যই তাদের ভানাকে সুস্পষ্টভাবে সুসংহত করতে জানতে হবে এবং
দলীয় কাজের অংশিদারদের মাধ্যমে কার্যক্রমকে সফলভাবে সহযোগিতা করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে
অবশ্যই তাদের ধারণাসমূহ বিনিময় এবং প্রকাশ করতে পারতে হবে। অতএব, অবশ্যই সংলাপে
নিয়োজিত হতে শিখতে হবে এবং গ্রহণযোগ্যতার সাথে অবদান রাখতে শিখতে হবে। এটা বাস্তব
জীবনে শিক্ষার্থীদের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।
উপসংহার:
উপরে বহুল আলোচিত ও অনুসৃত কনস্ট্রাক্টিভিজম শিখণ ত্ত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
জাঁ পিঁয়াজে এবং জন ডিউইসহ প্রখ্যাত সব শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীগণের শিখণ তত্ত্বগুলো
বিশ্বব্যাপী শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করা হয়ে আসছে। বর্তমানে শিক্ষক-কেন্দ্রিক
শিখণ-শেখানোর পরিবর্তে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক পদ্ধতি সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে।আর
কন্স্ট্রাক্টিভিস্ট তত্ত্বে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখণকে মূলত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
তাই, এ পদ্ধতি প্রাথমিক স্তরে কর্মরত শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ,
ডিপি-এড প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কোর্সে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছ।শিক্ষা
মনোবিজ্ঞানীগণের শিখণ তত্ত্বগুলো নিয়ে ইতোপূর্বে আমি কয়েকটি নিবন্ধ রচনা করেছি। যেমন-বেঞ্জামিন
ব্লুম, হাওয়ার্ড গার্ডনার, ইবনে সিনা প্রভৃতি।বর্তমান নিবন্ধটি পড়ে সংশ্লিষ্ট সকলে
উপকৃত হবেন বলে মনে করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন