শিককদের পেশাগত মানোন্নয়ন:
একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
মহান
সব শিক্ষক সারা বিশ্বে কাজ করছেন।কিন্তু, তাঁদেরকে পেশাগতভাবে আরও সমৃদ্ধ এবং দক্ষ
হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা সর্বত্র ভাবা হচ্ছে।এ লক্ষ্যে পৃথিবীর অনেক দেশে উন্নত মানের
শিক্ষক দল গড়ে তোলার জন্য পেশাগত মানোন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ ও
বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও শিক্ষকদেরকে পেশাগতভাবে দক্ষ ও যোগ্য করে তোলার
জন্য অব্যাহতভাবে প্রশিক্ষণ চলছে। বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে কর্মরত
শিক্ষকদের জন্য ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষকতা পেশাকে একদা মনে
করা হত; সবচেয়ে সম্মানজনক, স্থায়ী ও দীর্ঘ পেশা। কিন্তু মানুষের সে বিশ্বাসে পরিববর্তন
ঘটেছে। আর শিক্ষকতা এখন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।অনেক দেশের শিক্ষার্থী, অভিভাবক
এবং জনগোষ্ঠীর নিকট শিক্ষকগণ; আর অত পছন্দনীয় বা শ্রদ্ধেয় নন। অনেক পাশ্চাত্য দেশে
শিক্ষকদেরকেও এক প্রকার সরকারি আমলা বলে গণ্য করা হয়, যাঁরা পুরনো সব ধ্যান-ধারণায়
বিশ্বাসী হয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, যা শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটানোতে সক্ষম
নয়।তথ্য-প্রযুক্তির এ অত্যাধুনিক যুগে শিক্ষার্থীরা অনেক অগ্রসর হয়েছে, শিক্ষকগণ,
সেই সনাতন পদ্ধতিতে পাঠদানকারি শিক্ষকতার যুগে থেকে গেছেন। এটা শিক্ষকের ব্যক্তিগত
কোন দুর্বলতা নয়, পদ্ধতিগত সমস্যা এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিখণ-শেখানো এবং
শিক্ষাদান পদ্ধতিতে রাতারাতি পরিবর্তন সাধন করা অসম্ভব প্রায়। মানসম্মত বা উত্তম
শিক্ষা অর্জন করতে শিক্ষকতা পেশার মানোন্নয়নে একটি রূপকল্প তৈরি ও পরিকল্পনা নিয়ে
তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এশিয়া সোসাইটি কতৃক আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক
সেমিনারে এসব অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। এত আরও বলা হয় যে, প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে
দুর্বল শিক্ষকদের দিয়ে কাজ পরিচালনা না করা বা তাদেরকে চাকুরিচ্যুত করার কথা না
ভেবে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রদান, তাদের প্রশিক্ষণ দান এবং পেশাগতভাবে
সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
শিক্ষকদের পেশাগতভাবে দক্ষ করের তোলার
জন্য করণীয়সমূহ: এসিয়া সোসাইটি
আয়োজিত উক্ত সেমিনারে শিক্ষকদের পেশাগতভাবে সমৃদ্ধ ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য
বিভিন্ন প্রস্তাবনা এবং সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে নিন্মোক্ত বিষয়গুলো
উল্লেখযোগ্য
উত্তম শিক্ষক নিয়োগ দান: অতি কেন্দ্রিভুত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনাকারি
দেশগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে বা মাঠ পর্যায়ে কিছুটা দায়-দায়িত্ব এবং কর্তব্য
হস্তান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জনকারি
দেশগুলোতে বিদ্যালয় ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের
জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কোন কোন দেশে ভাল শিক্ষকদের অন্য পেশা
হতে এনে নিয়োগদান করা হচ্ছে।
নতুন শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের
আয়োজন: বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা
গেছে যে, নব-নিযুক্ত শিক্ষকগণ প্রথম ৫ বছর শিক্ষাদানে তেমন দক্ষতা প্রদর্শণে সক্ষম
হন না। তাঁদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। অনেক দেশে নব-নিযুক্ত শিক্ষকদেরকে
ইন্ডাকশন প্রশিক্ষণ বা শিক্ষানবীশকালীণ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।নতুন শিক্ষকদের জন্য
মেন্টরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। অধিকতর অভিজ্ঞ ও দক্ষ সহকর্মীগণ, নতুন সহকর্মীদের
প্রশিক্ষণ প্রদান, সহযোগিতা ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করার
প্রক্রিয়া হলো; মেন্টরিং। যিনি মেন্টরিং করেন, তিনি হলেন মেন্টর। আর নতুন সহকর্মী
যিনি মেন্টরের সহযোগিতা নেন, তিনি হলেন, মেন্টী। মেন্টর ও মেন্টীর মধ্যকার
আন্তক্রিয়াকে মেন্টরিং বলা হয়। বাংলাদেশে বিগত ১০/১৫ বছরে বিপুল সংখ্যক নতুন শিক্ষক/শিক্ষিকা
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। ডি.পি-এড, সি-ইন-এড বা অনুরূপ
পেশাগত ডিপ্লোমা অথবা সার্টিফিকেট কোর্স গ্রহণ করার পূর্বে শিক্ষকতার কাজ চালিয়ে
যেতে সক্ষম করে তোলার জন্য তাঁদেরকে ইন্ডাকশন প্রশিক্ষণ এবং মেন্টরিং পদ্ধতি
অনুসরণ এবং তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়ন: অধিকাংশ দেশে শিক্ষাদান চলাকালে শিক্ষকদের জন্য
পেশাগত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়ে থাকে এবং তাঁরা বাধ্যতামূলকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ
করে থাকেন। বাংলাদেশে শিক্ষকগণ; ডিপি-এড, সি-ই-এড প্রশিক্ষণ, সাব-ক্লাস্টার
প্রশিক্ষণ, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ
পাচ্ছেন। আবার বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক এবং বিদ্যালয় পরিচালনা কাজে সম্পৃক্ত
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি শিক্ষক-অভিভাবক কমিটি ও স্লিপ কমিটির অন্তর্ভুক্ত
সদস্যবৃন্দকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। আর বিদ্যালয় পরিচালনা বা আর্থিক
কার্যক্রম সম্পাদন এবং উপবৃত্তিসহ অন্যন্য অর্থ বিতরণ বা খাদ্য সামগ্রী বিতরণ
বিষয়েও প্রশিক্ষণ-কর্মশালার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এতসব প্রশিক্ষণের আয়োজন সত্বেও
সুসমন্বয়ের অভাব এবং প্রশিক্ষণসমূহের মধ্যকার সুসাঞ্জস্যতা রক্ষা না হওয়ায়, পেশাগত
উন্নয়নের প্রশ্নটি রয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ি তাঁদেরকে উত্তম পাঠদানে
সক্ষম করে তোলাই হওয়া উচিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচনের সময় অগ্রাধিকার
দেওয়া।আর যেসব শিক্ষককে পেশাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ও যোগ্য করে তোলা যাবে, শুধু
তাঁদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়াই ভাল। দুর্বল শিক্ষক বা যাঁদের পেশাগতভাবে সামর্থ্যবান ও
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাবাপন্ন করে তোলার সম্ভাবনা কম, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিলেও,
তেমন উপকার বয়ে আনবে না। আর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে
হবে।এসিয়া সোসাইটি আয়োজিত উক্ত সেমিনারে শিক্ষকগণের পেশাগত মানোন্নয়নের জন্য
নিন্মোক্ত সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হয়। এ সেমিনারে উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের
প্রতিনিধি, মন্ত্রী, শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ থাকেন। তাঁরা প্রতিবছর এ
ধরণের সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। এ সেমিনারে অংশগ্রহণকারি আলোচকগণ সুস্পষ্ট অভিমত
ব্যক্ত করেন যে, তাঁরা নিজ নিজ দেশে পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের পেশাগত
মানোন্নয়ন এবং মানসম্মত শিক্ষার বিকাশে আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন
করার ওপর জোর দেন। শিক্ষকদেরকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধকরণ ও কাংখিত সুযোগ-সুবিধা
প্রদান এবং মর্যাদা প্রদান করে তাঁদেরকে আত্নপ্রত্যয়ী ও যোগ্য করে তোলার মাধ্যমে
শিক্ষা ও শিক্ষকতার মানোন্নয়ন কার্যক্রমসমূহ অব্যাহত রাখতে হবে। সেমিনারে
অংশগ্রহণকারিগণ আগামী দিনের জন্য শিক্ষকতা পেশার মানোন্নয়নে নিন্মোক্ত পদক্ষেপসমূহ
গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশমালা পেশ করেন।
.
শিক্ষক প্রশিক্ষণ
ও বিভিন্ন পেশাগত উন্নয়নমূলক অর্জনগুলো জোরদার করতে হবে।
.
উচ্চতর
যোগ্যতাসম্পন্ন ও উদ্যমী শিক্ষক নিয়োগ দান করতে হবে। আর যেসব জাতিস্ত্ত্বার
শিশুদের জন্য স্ব-ভাষার শিক্ষক নেই এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার
লোকদের শিক্ষকতায় নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।
.
শিক্ষকদেরকে
তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে ও মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে হবে এবং
শ্রেপিণকক্ষে পাঠদান করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
.
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর
চাহিদা অনুযায়ি প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে।
.
প্রধান
শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর ও উন্নত প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে, যাতে তাঁরা সহকারি
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিখণ-শেখানো কার্যক্রম সার্থক ও সফলভাবে পরিচালনা করতে
সক্ষম হন।
.
পেশাগত
মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের শিখণ বা শিখণফল অর্জন করানোর প্রক্রিয়া সফলভাবে
পরিচালনায় সামর্থ্য বৃদ্ধিকরণের জন্য শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন
করতে হবে।
.
সরকার, কর্তৃপক্ষ,
শিক্ষক ও শিক্ষক প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মাঝে একটি সৃদৃঢ় ও সুমন্বয়মূলক
সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে।
উপসংহার: মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য উচ্চতর দক্ষতা ও
যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক অপরিহার্য। এটা সারা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশই উপলব্ধি করে
থাকে। ইতোমধ্যে, অনেক দেশ শিক্ষকদেরকে ভাল সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং পেশাগত
উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক গড়ে তোলে সুফল পাচ্ছে। এসিয়া
সোসাইটির মেমিনারে আলোচনার আলোকে বর্তমান নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে। নিবন্ধটি পড়ে
সংশ্লিষ্ট সকলে উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন