সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৫

Experiencing Finland Primary Education

ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক শিক্ষা সাফল্য
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ 
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাফল্য; বর্তমানে সারা বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করে আছে।ইতোপূর্বে আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা আলেচনা করেছি। আজকের নিবন্ধে ফিনল্যান্ডের সাফল্য নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পারদর্শিতার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। শিক্ষকগণকে এসব বিষয়ে দক্ষ করে তোলার কারণে, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শিক্ষার্থীদেরকে শিখন ফল ও যোগ্যতা অর্জন করাতে পারেন। এদেশের সবচেয়ে মেধাবীদের মধ্যকার ১০% কে শিক্ষকতায় নিয়োগ করা হয়। আর ৩,৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬২,০০০ শিক্ষক কর্মরত আছেন।কোন কোন বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা এত কম যে, শিক্ষকগণ প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ব্যাক্তিগতভাবে জানেন। শিক্ষণ শেখানোর কোন কৌশল ব্যর্থ হলে শিক্ষকগণ অন্য সহকর্মীদের সহায়তা নেন ও তা সমাধান করেন। শিক্ষকগণ শেখানোর যে কোন চ্যালেঞ্জ অবলীলায় মোকাবেলা করতে পারেন। ফিনল্যান্ডের শিশুরা প্রথম ৯ বছরে ৩০% শিখনে বিশেষ সরকারি সহায়তা পেয়ে থাকে।আর ফিনল্যান্ড একক জাতির দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও, প্রতি ১৫০ জন সশিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অভিসাসী শিশু; অভিবাসী শিশুদের মধ্যে রয়েছে; সোমালীয়, ইরাকী, রুশ, বাংলাদেশী, এস্তোনীয়, ইউরোপীয় এবং অন্যান্য দেশের। স্বচ্ছল পরিবারের শিশুরা বিদ্যালয়ে থাকলেও, শিক্ষকদের দৃষ্টি থাকে দরিদ্র শিশুদের প্রতি এবং তাদেরকে অত্যন্ত যত্নসহকারে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। প্রায় ৪০ বছর পূর্ব হতে ফিনল্যান্ড সরকার শিক্ষার উন্নয়নে দৃষ্টি দিলেও, বিগত ২০০০ সাল পর্যন্ত এতে তারা তেমন সাফল্য পায়নি। ২০০০ সালে ৪০ টিরও বেশি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে ফিনল্যান্ডের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি পঠন-পাঠনে পারদর্শি বলে চিহ্নিত করা হয়। তিন বছর পরে ২০০৩ সালে তাদের ‍শিশুরা গণিতেও সেরা বলে প্রমাণিত হয়। ২০০৬ সালে, ৫৭ টি দেশের ওপর পরিচালত এক সমীক্ষায় ফিনল্যান্ডের শিশুরা বিজ্ঞান বিষয়েও সেরা বিবেচিত হয়। ২০০৯ সারে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী মূল্যায়ন সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ফিনল্যান্ডের শিশুরা সার বিশ্বে বিজ্ঞানে দ্বীতিয়, পঠন-পাঠনে তৃতীয় এবং গাণিতিক দক্ষতায় ৬ষ্ঠ স্থান অর্জন করে। ফিনল্যান্ডে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপন পরীক্ষা ছাড়া আনুষ্ঠানিক কোন কেন্দ্র পরীক্ষা গ্রহন করা হয় না। সেখানে কোন রেংকিং বা কোন তুলনা বা ছাত্র/ছাত্রীর মধ্যকার কোন প্রতদ্বেন্দ্বিতা বা বিদ্যালয়ের মধ্যে অথবা অঞ্চলের মধ্যেও কোন প্রতিযোগিতা নেই। সেদেশের বিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় সরকারি অর্থে। বিদ্যালয় পরিচালনায় জাতীয় পর্যায় হতে নিন্ম স্তর পর্যন্ত যারা জড়িত তারা শিক্ষা বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারি। কোন ব্যবসায়ি, সামরিক কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতা শিক্ষা কার্য্ক্রম পরিচালনায় সংযুক্ত নন। প্রত্যেক বিদ্যালয় পরিচালিত হয়; জাতীয় একক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং শিক্ষকগণ সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একই বিষয়ে বা পাঠ্যকক্রমে শিক্ষা গ্রহন করে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়েছেন। ফলে, ফিনল্যান্ডের শিশুরা গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র একই ধারর শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পেয়ে থাকে। সবল-দুর্বল শিক্ষার্থীর মধ্যকার পার্থ্ক্যও খুবই কম। তাদের শিক্ষায় সমতার বিষয়টি খুব গুরুত্ব পেয়ে থাকে। আর জাতীয়ভাবে সরকারি ও বিরোধী দলীয় সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শিক্ষার মানোন্নয়নে একমত পোষণ করেন। এ নিয়ে তাদের মথধ্য কোন বিরোধ নেই। ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে প্রায় ১০০% শিক্ষার্থী মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে পড়াশোনা অব্যাহত রাখে এবং স্নাতক ডিগ্যী বা কারিগরী বিষয়ে সনদ লাভ করে থাকে, যার হার যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১৮% বেশি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রতি জন শিক্ষার্থীর জন্য যা ব্যয় করে, ফিনল্যান্ড তার চেয়ে ৩০% কম খরচ করে থাকে। ফিনল্যান্ডের একজন প্রাক্তন গণিত শিক্ষক বলেন, “তাদের শিশুদের কীভাবে শিখতে হয়, তা শেখানো হয়, কীভাবে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় তা নয়।” সে শিক্ষক আরও বলেন, “তাদের শিশুদের আন্তর্জাতিক মানদন্ডে অগ্রগামি হওয়া নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।”
ফিনল্যান্ডের শিশুরা শিখে খেলতে খেলতে, আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে।শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষকদের চেয়ে শ্রেণিকক্ষে কম সময় তিয়ে থাকেন। শিক্ষকগণ পাঠদান কৌশল ও শিখন-শেখানো বিষয়বস্তু নির্ধারণ, উপকরণ তৈরি, পাঠদান প্রস্তুতি এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে অতিরিক্ত সময ব্যয় করে থাকেন। শিক্ষার্থীরা খেলা-ধুলার মাঝেই অনেক সময় কাটায়। বাড়ির কাজ দেয়া হয় অতি সাধারণ পরিমাণের। আর ৭ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তাদের ভাবনা হলো, শিশুদের শিক্ষা গ্রহণ উপযোগি না হওয়া পর্যন্ত, তাদের শিখন-শেখানোতে বাধ্য করা ঠিক নয়। সেখানকার কোন শিশু গৃহহীন বা অভুক্ত থাকে না। ফিনল্যান্ডে নারী শিক্ষকদের মাতৃত্ব ছুটি দেয়া হয় ৩ বছর। ডে-কেয়ারের জন্য অভিভাবকদেরেকে ভর্তুকি দেয়া হয় এবং ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশদের বিদ্যালয় ভর্তিপূর্ব শিখন ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়।তাছাড়া, সরকার একজন শিশু ১৭ বছর বয়সে না পৌঁছা পর্যন্ত, প্রতিমাসে ১৫০ ইউরো করে ভর্তুকি দেয়। ৬ বছর বয়সে ৯৭% সরকারি সহায়তায় বিদ্যালয় ভর্তিপূর্ব শিক্ষায় ভর্তি হয়ে থাকে। এস্তরে শিশুরা হালকা চালে পড়াশোনা করে থাকে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদেরকে খাবার, স্বাস্থ্য সেবা ও পরিবহন সুবিধা দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা বিনা খরচে স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকে।
১৯৬০ সালের দিকে ফিনল্যান্ড ছিল একটি অস্থিতিশীল ও শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা দেশ। এসময় সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব-বলয়ে থাকার কারণে তারা শিক্ষাসহ অন্যান্য খাতে তেমন উন্নতি করতে পারে নি। তখন ৬ বছর বয়সী শিশুরা সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বেশির ভাগই ঝরে পড়ত। বাকি শিশুরা বেসরকারি কিছু সাধারণ মানের বিদ্যালয়ে ভর্তি হত। শুধু ধনিক-বণিক শ্রেণির মানুষের সন্তানেরা মানসম্মত শিক্ষা পেত। তারা শত শত বছর ধরে সুইডেন ও রাশিয়ার ঔপনিবেশিক জাঁতাকলে পড়ে বিধ্বস্থ হয়ে আসছিল। সুইডিশরা ৬০০ বছর ফিনল্যান্ডকে শাসন করে।১৮০৯ সালে রাশিয়া দেশটিকে দখল করে নেয়। ১৯১৭ সালে তারা স্বাধীনতা লাভ করে। অতপর গ্রহযুদ্ধ দেশটিকে বিধ্বস্থ করে দেয়। ১৯৩৯ সাল হতে ১৯৪৫ সালের মধ্যে দুবার রাশিয়ার সাথে এবং জার্মানের সাথে একবার যুদ্ধে জড়িয়েছিল ফিনল্যান্ড। ১৯৬৩ সালে ফিনল্যান্ড সংসদে শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। এরপর হতে তারা ধীরে ধীরে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিকশিত ও উন্নত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে তারা ২০০০ সাল পর্যন্ত তেমন শিক্ষা সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও, এর পর হতে বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় চমক দেখিয়ে আসছে।
উপরে ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাফল্য নিয়ে আলোচনা করা হলো। বাংলাদেশও তাদের গৃহীত প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নমূলক পদক্ষেপগুলো ভেবে দেখতে পারে।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন