রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫

South Korean Primary Education: A Lesson for us

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাথমিক ‍শিক্ষায় সাফল্য
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ 
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে যে কটি দেশ বিশ্বব্যাপী শীর্ষে অবস্থান করছে, দক্ষিণ কোরিয়া সেগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। সারা প্রথিবীর প্রাথমিক শিক্ষা চিত্র নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা গবেষণা সমীক্ষা চালিয়ে প্রতি বছর প্রতিবদন প্রকাশ করে থাকে। এতে শিশু ভর্তি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের হার, ঝরে পড়ার হার এবং সর্বোপরি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রভৃতি সূচক যাচাই করা হয়। সব ধরণের সূচকে ফিনল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রাথমিক শিক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন অব্যাহত রেখেছে। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের চেয়েও তাদের সাফল্য বেশি। চীন এবং জাপানও তালিকায় পথম দিকে আছে। যাহোক, আজকের নিবন্ধে প্রাথমিক শিক্ষায় দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য তুলে ধরা হবে।
প্রাক-শৈশবকালিন শিক্ষাস্তর: দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাক-শৈশবকাল হতে শিশুদের মৌলিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। শুধু জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় এস্তরকে গুরুত্ব দেয়া হয় না, স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিমান শিশু হিসেবে গড়ে তোলা এবং দরিদ্র শিশুদের কল্যাণ সাধন এবং কর্মজীবী নারীদের শিশুদের কথাও এতে বিবেচনা করা হয়। নার্সারী স্তরে প্রাক-শৈশবে শিশুদের শিখণ-শেখানো চলে। এস্তরে এসব শিশুর শিখনের কল্যানমূলক নীতির প্রতিফলন ঘটানো হয়। ১৯৫২ সালে নার্সারী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে এবং ১৯৬২ সালে শিশু কল্যাণ আইনের মাধ্যমে তা বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৮০-এর দশকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া শিশু বা প্রাক-শৈশবকালীন শিক্ষার বিকাশে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। এ আইনের আওতায় গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র নার্সারী শিক্ষার প্রসার ঘটে। তাছাড়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এভাবে তাদের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নার্সারী বা প্রাক-শৈশবকালীন শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপক সুযোগ সৃস্টি হয়। এই কিন্ডারগার্টেন বা নার্সারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি ভর্তুকী দেয়া হয় না, বেসরকারিভাবেই তা পরিচালনা করা হয়। বিদ্যালয়ে শিশুদের আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তি হওয়ার পূর্বে চলা প্রি-স্কুল শিক্ষাস্তরটি একটি নতুন প্রবণতা; যা ধর্মীয়ভাবে, সামাজিকভাবে এবং বেসরকারিভাবে পরিচালনসা করা হয়ে থাকে। আর সরকার, এ স্তরকে উৎসাহিত করতে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। বর্তমানে ১০০ ভাগ শিশু, যারা ৫ বছরের মধ্যে তারা এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকে।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা: ১৯৪৫ সাল হতে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। আর ১৯৭৯ সাল হতে প্রাথমিক শিক্ষা বিনা বেতনে পরিচালিত হয়ে আসছে। ৬ বছর বয়সে সাধারণত সে দেশের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে ভর্তি হয এবং প্রতি বছর এক একটি শ্রেণিতে উন্নীত হয়। মেধাবী ও প্রতিভাবান শিশুদেরকে কখনও কখনও ডাবল প্রমোশন দেয়া হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে ৯ টি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়্ আর সেগুলো হলো; কোরীয় ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, শারিরীক শিক্ষা, সমাজ বিজ্ঞান, নৈতিক শিক্ষা, চারু ও কারু কলা। শিক্ষার আন্তার্জাতিকীকরণকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।ইংরেজি বিষয়টি তৃতীয় শ্রেণি হতে পড়ানো হয়।১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে দ্রুত শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় শহর এলাকায় বিদ্যালয় গমনোপযোগি শিশুদের ওপর বেশ জোর দেয়া হয়।আর শ্রমিক এলাকায় তা হ্রাস পায়। শহুরে বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র/ছাত্রীর ভর্তির চাপ অত্যধিক বেশি হওয়ায়, ডাবল শিফট চালু করা হয়। সরকার ১৯৮২ সালে, জনগণের ওপর শিক্ষা কর আরোপ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে । আর শিক্ষা খাতে ব্যয় এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষার্ ও শিক্ষকদের মধ্যকার অনুপাত হয়, ১:২৮ জন। ১৯৬০-এর দশকেই তাদের বিদ্যালয় গমনোপযোগি ১০০ ভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্  ১৯৪৫ সালে স্বধীনতা লাভের সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল, ২,৮০৭ টি। আর ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১,৫৭,০০০ জন। ১৯৯৯ সালে, প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং অনুরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫৪৪ টি সরকারি ও বেসরকারি ৭৩৯ টি। ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৯৩৫০০০ জন। এভাবে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও শিশু ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনকারি ১০০ ভাগ ছাত্র/ছাত্রীই মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে ভর্তি হয়ে থাকে।
সার্জনীন প্রাথমিক শিক্ষা চিত্র: জাতিসংঘ নির্ধারিত সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রার দ্বিতীয়টি হচ্ছে; সার্জনীন প্রাথমিক শিক্ষা। ২০১৫ সালকে এ লক্ষ্য অর্জনের বছর ধরা হয় প্রত্যেক ছেলে শিশু-মেয়ে শিশুর সমভাবে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণকে এতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। সারা বিশ্বে এখনও ১০০ মিলিয়নেরও বেশি বিদ্যালয় গমনোপযোগি শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তিবহির্ভুত রয়ে গেছে। বিদ্যালয়ে ভর্তি বহির্ভুত শিশুদের অধিকাংশই সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর। সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার পর হতে চীন, চিলি, কিউবা সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকা সার্ব্জনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিদকরণের ক্ষেত্রে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে।
ইউনেস্কোর সমীক্ষা অনুযায়ি ১৯৯১ সাল হতে অর্জিত সাফল্যগুলো নিন্মরূপ;
-১৯৯৯ সাল হতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার বেড়েছে, ৪০ মিলিয়নেরও বেশি।
-সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশগুলোতে ছাত্র/ছাত্রীর ভর্তি হার বেড়েছে, ৫৮% হতে ৭৪% ভাগ।
-মৌলিক শিকষার উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাসমূহের প্রতিশ্রুতি ২০০২ সালে যা ছিল ২.১ বিলিয়ন ডলার, তা ২০০৭ সালে ৪.১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
উল্লেখিত অর্জনগুলো সত্বেও, ২০১৫ সালের মধ্যে প্রত্যেক শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে কিনা সন্দেহ বয়ে যায়।১২০ মিলিয়নেরও বেশি শিশু বিদ্যালয় ভর্তিবহির্ভুত থেকে যেতে পারে, ২০১৫ সালের পরও। সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে এসব শিশুর সংখ্যা বেশি। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে দাতা সংস্থাগুলো নিন্মোক্ত প্রতিবন্ধকতার মুখোমখি হচ্ছে;
-প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা না পাওয়া।
-প্রয়োজন থাকা সত্বেও পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা না পাওয়া।
-সাহায্য গ্রহণকারি দেশগুলোর উদাসীনতা।
সর্বোপরি, দুর্গম, সুবিধা বঞ্চিত এলাকা বা দেশসমূহ, যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ এবং অস্বচ্ছল পেশার মানুষের বসতি সম্পন্ন এলাকা এবং জনসংখ্যা ব্রদ্ধি প্রভৃতি কারণে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।
উপরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা সাফল্য ‍নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সাফল্যের কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মূলত প্রাক-শৈশবকাল হতে শিশুদের শিখনে আগ্রহী করে তোলা এবং জাতীয়ভাবে দৃঢ় অগ্ঙীকার থাকায়, তারা সফল হচ্ছে। বাংলাদেশও তাদের পথ অনুসরণ করতে পারে।    







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন