শিক্ষায় উন্নয়ন: একটি পর্যবেক্ষণ
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
বিশ্বব্যাপী
সকলে বিশ্বাস করেন এবং অনুসরণ করার চেষ্টা করেন যে, শিক্ষা একটি অধিকার।আর শিক্ষায়
বিনিয়োগ একটি চমৎকার ধারণা। এটা কেন? কারণ শিক্ষা মানুষকে এমন এক দক্ষতা অর্জন
করিয়ে দেয়, যা তাদেরকে দারিদ্র্য হতে মুক্তি দেয়, সমৃদ্ধি এনে দেয়।আরও কত কী?
শিক্ষাই পারে, এ পৃথিবীকে বদলে দিতে। নিজেকে জানা, বুঝা, দেশকে ও দেশের মানুষকে
ভালবাসা ও সেবা দিতে, সর্বোপরি নিজেকে বিশ্ব মানব সম্পদে পরিনত করার জন্য শিক।ষাই
একমাত্র অস্ত্র। শিক্ষাটা হতে পারে, এ পৃথিবীর যে কোন বিষয়ে। হ্যাঁ, শিক্ষা হতে
পারে কর্মমুখি ও বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটে এমন।শুধু পান্ডিত্য ফলানো অথবা সনদ
যোগাড় করলেই হবে না, শিক্ষার আলোকে কাজ করে দেখাতে হবে। যাহোক, বিশ্বকে বদলাতে
দিতে শিক্ষার ভূমিকা কত যাদুকরি হতে পারে, কিছু উদাহারণ এ নিবন্ধে তুলে ধরা হবে।
১.স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন: শিক্ষিত মানুষ রোগ-শোক উত্তমভাবে প্রতিরোধ
করতে পারে এবং স্বাস্থ্য সেবাকে দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারে। যেমন-প্রাথমিক
শিক্ষা সম্পন্নকারি তরুণ-তরুণীরা এইডস রোগের মত মারাত্নক সব রোগ হতে মুক্ত রয়েছে,
যারা পড়াশোনা করেনি, তাদের চেয়ে অনেক বেশি হারে। শিক্ষিত মা‘দের শিশুরা সুস্থ সবল
হয়।
২.উচ্চতর মজুরী এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন
ভাল হয়: অনেক দরিদ্র দেশের শিক্ষিত মানুষেরা, ১০% হারে বেশি মঞ্জুরী বা
বেতন-বাতা পায়। এ উপার্জন জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরত্বপূর্ণ অবদান
রাখে।কোন দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ৪০% যদি শিক্ষিত না হয়, তবে
সেদেশ অব্যাহত সাফল্য অর্জন এবং দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না।
৩.গণতন্ত্র টেকসই হয় এবং রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতা বজায় থাকে:
শিক্ষা, সুশীল সমাজ, গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহয়তা করে, মানুষকে
তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার মাধ্যমে এবং দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের
মাধ্যমে।
৪.সুস্থ পরিবার ও সমাজ প্রতিষ্ঠায়
সহায়ক হয়: কোন কোন
দেশ নারী শিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা থাকলেও, যে সব দেশে নারীরা শিক্ষিত, পরিবার ও সমাজে
তাদের অবদান অভাবনীয়। যে নারী প্রাথমিক শিক্ষা হতে উপরের স্তরের শিক্ষা গ্রহন
করেছে, সে বয়স্কদের সেবা, শিশু জন্ম এবং শিশুর জন্মের পরে যত্ন নেয়া, মাতৃ মৃত্যু
এবং শিশু মৃত্যু বা অসুস্থতার ঝুঁকি হ্রাসে তারা বিরাট ভুমিকা পালন করে থাকে।
৫.উন্নত বিশ্বে কেন শিক্ষা প্রয়োজন?—মার্কিনীরা
কী ভাবে? ৯১% মার্কিন নাগরিক মনে করে. মৌলিক শিক্ষার বিকাশ জাতিকে
দারিদ্র্যমুক্তকরণের একটি কার্যকর উপায়। ৮৪% মার্কিনী একমত পোষণ করে যে,
স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে বৈদেশিক সাহায্য বৃদ্ধি করা উচিত। অন্যান্য সকল খাতে
অর্থ সহায়তা দেয়ার চেয়ে শিশু শিক্ষা খাতে বা শিশু উন্নয়নমূলক খাতেই বেশি
মার্কিনীরা অর্থ সহায়তা দেয়া, পছন্দ করে। তাছাড়া, দরিদ্র দেশের মানুষজনকে
প্রশিক্ষণ দেয়া এবং নারী উন্নয়ন ও মেয়ে শিক্ষার প্রসারেই তাদের আগ্রহ। উন্নয়নশীর
দেশগুলোর কুষি খাতে অবদান রাখে নারীরাই বেশ্। বৃহত্তর নারী সমাজকে শিক্ষিত করে
তুলতে পারলে, ১৯৭০ সাল হতে দেখা যায় যে, কৃষি পণ্য উৎপাদন এবং অপুষ্টি দূর করার
ক্ষেত্রে ৪০% ভাগের বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
৬.শিক্ষা ও মার্কিন সাফল্য: শিক্ষায়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য দীর্ঘ দিনের। ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা লাভের সময সাদা
বর্ণের মার্কিন নাগরিকদের অর্ধেকের কম এবং কালো বর্ণের কোন শিশুই বিদ্যালয়ে যেত
না। বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক শিশু ৬ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে এবং প্রায়
সবাই মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে পড়াশোনা অব্যাহত রাখে। ১৭৭৬ সালে, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থানে ছিল, অনেক দেশ প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে সে অবস্থানে আজও
পৌঁছতে পারেনি। যেমন- ইথিয়োপিয়ার মাত্র ১৩% শিশু প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করে,
সুদানে ৫৩% এবং নাইজারে ৩০% । ১৯০০ সাল পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সকল শিশুর
জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে নি। সেসময়ে মার্কিনীদের গড় আয় ছিল, বছরে
৪,৫০০ মার্কিন ডলার যা ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের বর্তমান মাথাপিছু আয়ের চেয়ে ৬%
বেশি।আর উগান্ডার চেয়ে ১৫ ভাগ বেশি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিক
শিক্ষা স্তরে অধ্যয়নরত প্রত্যেক শিশুর জন্য বছরে ৬,৮০০ ডলার ব্যয় করা হয়। ইরানে
১৫৬ ডলার, ভারতে ৬৪ ডলার, লাউসে ৩০ ডলার এবং রোয়ান্ডায় ১৯ ডলার।
৭.বিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়া শিশু, আন্তর্জাতিক চিত্র: বাংলাদেশের বিদ্যালয়
গমনোপযোগি শিশুদের মধ্যে ভর্তি বহির্ভূত শিশু তেমন নেই। পশ্চাৎপদ এলাকা, যেমন-
পার্বত্য এলাকা, দীপাঞ্চল, চরাঞ্চল, বস্তি এলাকাসহ বিশেষ কিছু এলাকায় এখনও শতভাগ
শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। বিশ্বের অনেক অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এখনও বেশ কিছু
শিশু বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে না।
৮.দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের চিত্র:
উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬ হতে ১০ বছর বয়সের ১১৫ মিলিয়নের বেশি শিশু, যাদের সংখ্যা ৩ হতে
৫ শতাংশ মেয়ে শিশু; এখনও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে না। আর ১৫০ মিলিযনেরও বেশি
উন্নয়নশীল দেশের শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষা সমাপন না করে ঝরে পড়ে।
সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রতি ৩ জন শিশুর মধ্যে মাত্র ১ জন প্রাথিমিক
শিক্ষা সমাপন করে থাকে। সাব-সাহারান আফ্রিকা, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের
দেশগুলোতে বিদ্যালয় ভর্তি বহির্ভুত শিশুর সংখ্যা বেশি।
৯.সাফল্য সম্ভব: বিশ্বব্যপী উন্নত-অনুন্নত
সব দেশে প্রাথমিক ও শিশু শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চলছে।
সরকারি-বেসরকারি এবং অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থা, এ ক্ষেত্রে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে
যাচ্ছে। আর আশার কথা হলো, শিক্ষা গ্রহণের হার নিত্যই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১০.শিশু শিক্ষা বিকাশে কার্যকর
কৌশলসমূহ: দরিদ্রতম
দেশ যেমন-মাদাগাস্কার, ফাসো ও নিকারাগুয়াতে নারী শিক্ষার হার দ্রুত বাড়ছে।
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, বোতসোয়ানা, পেরু ও জ্যামাইকাতে শত ভাগ
শিশু প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ১০৫০ সালে স্বাধীনতা উত্তর
দক্ষিণ কোরিয়ায় মাথাপিছু আয় ছিল ৮৯০ ডলার। মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের সহায়তায় তারা
তা হতে উল্লেখযোগ্য অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে।তারা শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়ন
এবং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে অধিক দক্ষ শ্রম শক্তি গড়ে
তোলে, প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হার বৃদ্ধিতে সফল হয়। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায়
প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শিশু ভর্তির হার ১০০ ভাগ এবং বছরে মাথা পিছু বার্ষিক আয়
১৭০০০ ডলার। উগান্ডায় প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি অর্থ ব্যয়ের তদারকি ক্ষমতা দিয়ে
পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অন্যান্য সংস্কারের পাশাপাশি তারা শিক্ষা
খাতে ৩০% হতে ৫০% অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। এয্গালা ২০০৪ সালে বিদ্যালয় উন্নয়ন,
শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ করে ২৯,০০০ প্রাথমিক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ
দেয়ার জন্য ৪০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রাথমিক স্তরে শিশু ভর্তি বৃদ্ধির জন্য ৯০% অর্থ
ব্যয়ের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করে।
১১.আন্তর্জাতিক শিক্ষা সহায়তা: উন্নয়নশীল বা
দরিদ্র দেশগুলোর প্রাথমিক শিক্ষা খাতের উন্নয়নে প্রচুর অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশ এবং দাতা সংস্থাসমূহ
এসব অর্থ যোগান দিচ্ছে।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা দেখতে পাই যে, শিক্ষাই
কোন দেশ বা জাতির উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। শিক্ষা, এ ক্ষেত্রে যাদু-মন্ত্রের মত
কাজ করে। সকল ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে চাইলে, শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।
আমরা জানি, সহশ্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বা শিশুর মানসম্মত
শিক্ষা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশও শিক্ষার সামগ্রিক বিকাশে ও উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া
হচ্ছে। সুতরাং দেশপ্রেম নিয়ে সবাই কাজ করলে, আমরা একদিন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে
যাব। সমগ্র বিশ্ববাসীও উন্নত হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন