একবিংশ শতকের শিক্ষার লক্ষ্য কী?
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী,
কক্সবাজার।
শিক্ষার
লক্ষ্য কী? এ বিতর্কের শেষ নেই। তবে, শিক্ষা যে মানব আচরণের বাঞ্চিত পরিবর্তন সাধন
করে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আবার শিক্ষিত মানুষের মন, শরীর ও আত্নার সমন্বিত
রূপান্তর ঘটে। শিক্ষার লক্ষ্য হবে, সত্য সন্ধান করা এবং মানুষের উন্নতি ঘটানো।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে কর্মমুখি করে গড়ে তোলাও, শিক্ষার উদ্দেশ্য।এর চেয়েও বড়
কথা হলো, শিক্ষার লক্ষ্য হবে, শিক্ষার্থীদেরকে সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার জন্য অধিক
সামাজিক, শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধন করা। বিগত ৫০ বছরেরও
বেশি সময় ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান ও চীনের সাথে বিশ্ব অর্থনীতি, সমর কৌশল এবং
রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিতর্ক চলছে।সম্প্রতি, বিশ্বব্যাপী
যুক্তরাষ্ট্রের উইন্সকন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মমুখি শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে একটি
বিতর্ক পরিচালনা করা হয়। আবার, শিক্ষা যুব সমাজকে বাস্তব জীবনে, কর্মজীবনে এবং
সুনাগরিক হয়ে ওঠতে কীভাবে ভূমিকা রাখে; এমন ভাবনাগুলো এবং মানুষ কীভাবে এ পৃথিবীতে
বেঁচে থাকবে সে বিবেচনাগুলোও আলোচনাও এসেছে। ক্রিটিক্যাল চিন্তা-ভাবনা, সৃজনশীলতা,
আন্ত:ব্যক্তিক দক্ষতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ; একটি সফল জীবনের কর্মমুখি এবং
সুনাগরিক হয়ে ওঠতে সামগ্রিক প্রভাব থাকবে। যেমন- ব্যক্তিগত সম্পর্কর অশান্তি
কর্মপরিবেশকে ও পারিবারিক জীবনকে ব্যাহত করে। ‘কারও অন্যটি ছাড়া, একটিও নেই’; এমন
এক প্রবাদ বাক্য এখানে প্রযোজ্য হতে পারে। দৈনন্দিন শিক্ষা এবং শিক্ষানীতি,
উভয়মুখি লক্ষ্য এখানে প্রাসঙ্গিক। এখন আমরা দেখব, নিন্মোক্ত ৮ টি শ্রেণি
শিখন-শেখানোর কৌশল অবলম্বনকে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করতে পারি।
১.বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া যেতে
পারে: যেমন ক্যান্সার হওয়ার কারণ,
প্রাকৃতিক দুর্যাগের কারণ এবং সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আর
শিক্ষার্থীরা এধরণের বিচিত্র প্রশ্ন করবে। আবার শিক্ষকের সহায়তায় এসব প্রশ্নের
জবাব বা সমাধান খুঁজে পাবে। এসব তাঁদের বাস্তব জীবন, কর্ম জীবন ও সুনাগরিক হয়ে
ওঠতেও তাদের মনে রেখাপাত করবে, শুধু প্রশ্ন করা ও জবাব দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে
না।
২.মডেল তৈরি করতে হবে এবং তা উন্নত করতে হবে:
মডেল তৈরি ও উপস্থাপনের ফলে শ্রেণি পাঠদান হতে শিক্ষার্থীরা অনেক জটিল বিষয় দ্রুত
ও যথাসময়ে আত্নস্থ করে নিতে পারে। মডেলের সাহায্যে গণিত ও বিজ্ঞানের
পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং যুক্তিগত সমস্যা সমাধানমূলক কার্যক্রমে তাদের শিখন ভালভাবে
হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকগণ, ছাত্র/ছাত্রীদের সামনে পাঠ উপস্থাপন করে বিষয়বস্তু
সুস্পষ্ট করেন, ব্যাখ্যা করেন, শুদ্ধ করে দেন এং বোধগম্য করে তুলেন। শিক্ষকগণ শুধু
শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেই ক্ষান্ত হন না, বিষয়বস্তু গভীরভাবে এবং স্থায়ীভাবে
শিখন-শেখানোর আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। আর এ শিখনকে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবন,
কর্মজীবন এবং সুনাগরিক হয়ে ওঠার জন্য তা অনুসরণ ও প্রয়োগ করে থাকে। আর তাদের শিখনে
কোন বিষয় জটিল, কিন্তু খুবই উপকারি হলে, তারা তা নিয়ে পরবতীর্তে আরও অনুসন্ধান
এবং গবেষণা চালিয়ে যায়। আর শিক্ষক কতৃক উপস্থাপিত বা প্রদর্শিত মডেলগুলো তাদের
পাথেয় হিসেবে কাজ করে।
৩.পরিকল্পনা করে ও অনুসন্ধান করে যেতে হবে:
অনুসন্ধানের লক্ষ্য বে, প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বা কাল্পনিক বা অনুমান নির্ভর অথবা
প্রথাগত শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া হতে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়ন, সংশোধন
বা ফিডব্যাক দিতে হবে। উদাহারণ হিসেবে বলা যায় যে, প্রাকৃতিক দুর্যাগের কারণ বললেই
হবে না, এটা হতে বেঁচে যাওয়া বা প্রতিরোধ-প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলো নিয়ে
অনুসন্ধান চালানোর সময় প্রচলিত ধারণাসমূহ ছাড়াও, আরও কী কী ব্যবস্থা হতে পারে, তাও
ভেবে দেখতে হবে এবং অনুসন্ধান করবে ও তা অবলম্বন করবে। এ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্য
বিশ্লেষণপূর্বক বহুমুখি বিকল্প শিখনফল বের করে নিবে। এভাবে ভাল করে বিষয়টি শিখন
হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা ৩ টি মৌলিক ক্ষেত্র খুঁজে পাবে। প্রাপ্ত তথ্য বা প্রশ্নের
উত্তরকে সুসংগঠিত করবে, শিক্ষার্থীরা। আর যে সব প্রশ্ন আসবে না, তাও যে,
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ধারণ করতে পারে তাও বুঝবে। অধিকন্তু, একটি সক্রিয় শ্রেণিকক্ষে
যেখানে আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকবে, শিক্ষার্থীরা শিখবে যে, একই তথ্য ব্যবহার
করে বিভিন্ন মানুষ, বিভিন্ন সমাধান পায়, শুধু খারাপ জীবন দক্ষতা অর্জন করে না।
৪.তথ্য বিশ্লেষণ ও তার ব্যাখ্যা সন্ধান করা:
পাঠ্য-পুস্তক এবং শিক্ষকগণের অর্জিত জ্ঞানের আলোকে নতুন তথ্য-উপাত্ত;
শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে বিশ্লেষণ এবং বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করবে। নতুন নতুন সমাধান
ও সমাধান খোঁজার পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে।
৫.গাণিতিক পরিসংখ্যান ব্যবহার ও কম্পিউটার-তথ্য-প্রযুক্তির
প্রয়োগে তা কাজে লাগানো: তথ্য-উপাত্ত নিজে নিজে কোন সমাধান খোঁজে পায় না।
ব্যাখ্যা ও সমাধান খোঁজার জন্য তথ্য-উপাত্তকে ব্যবহার এবং প্রয়োগ করতে হবে।
শ্রেণিকক্ষে এসব কৌশল প্রয়োগে ছাত্র/ছাত্রীরা গুরুত্বপূর্ণ অথচ তাৎক্ষনিকভাবে
উথ্থাপিত প্রশ্নের সমাধান দেবে, এমন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এসব তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ,
পরিষ্থিতি বিবেচনা ও বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এসবের প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি এতে
প্রাধান্য পাবে। ছাত্র/ছাত্রীরা প্রচলিত ও আধুনিক; উভয় ধরণের পদ্ধতি প্রয়োগ করবে।
বিশেষত: জটিল সব পদ্ধতি বা জটিল সব সমাধান, গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং কম্পিউটার
ভিত্তিক বিশ্লেষণ করা কঠিন।ছাত্র/ছাত্রীরা গাণিতিক সম্ভাব্য সমাধানকে শুধু
মুখস্থকরণের বিষয় হিসেবে দেখে না, তারা এটাকে একটি বহুমুখি উদ্দেশ্য সম্বলিত শিখন
ফল অর্জন।
৬.
ব্যাখ্যাসমূহকে কাঠামোগত রূপ দান এবং
সমাধান বের করা: যে কোন বিষয়, সমস্যা বা জটিলতা শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের তা
ব্যাখ্যা করবে এং কাঠামোগত রূপ দেবে এবং সমস্যাগুলো বিষয়াদিতে সমাধান হিসেবে দাড়ঁ
করাবে।
৭.প্রামান্য বিতর্কর আয়োজন: শিক্ষার্থীদের
শিখনের লক্ষ্য হবে, প্রচলিত ও নির্ধারিত পাঠ্যবিষয় বা পাঠ্য বিষয়বস্তু হতে অজির্ত
শিখনফলকে যৌক্তিকভাবে কাঠামোগত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া; সেটা হোক না বিজ্ঞান বিষয়
বা গণিত। প্রামাণ্য বিষয়গুলো যুক্তি-তর্ক, বিষয়গুলো বিশ্লেষণ অথবা পুণর্বিশ্লেষণ
অথবা সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টাসমূহকে একটি কাঠামোগত রূপ দিতে হবে। নৈর্ব্যক্তিককরণ
ও সেগুলোকে প্রামাণ্য দলিলে রূপান্তর করে নিতে হবে। আর তা জীবন, কর্ম ও বৃহত্তর
পরিসরে নাগরিক জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
৮.তথ্য সংগ্রহ, মূল্যায়ন ও যোগাযোগ স্থাপন:
বিজ্ঞান ও প্রায়োগিক বিষয়ের অনুশীলণ, দূরদর্শী জ্ঞান ও সমাধান খোঁজার প্রক্রিয়া
এবং সদা উন্নয়ন কামনা করতে হবে। যেহেতু অন্যদের সাথে যোগাযোগের উপকারিতা বয়ে আনবে
এতে, শ্রেণি কক্ষে এসব কৌশল প্রয়োগ ও অনুশীলণ হবে, সযোগিতামূলক, প্রিতিফলনমূলক এবং
বিকল্প ভাবনাগুলো হবে উন্মুক্ত। আর, এসব কর্মকান্ড শিক্ষার্থীদের বাস্তবজীবন, কর্মজীবন
ও সামাজিক-রাজনৈতিক বৃহত্তর পরিসরে এর প্রভাব-প্রতিফলন দেখা যাবে।
যাহোক,
একবিংশ শতাব্দীর শিখন ফলগুলো হবে, বাস্তবজীবন, কর্মজীবন ও নাগরিক জীবনে যার
প্রতিফলন ঘটবে, এমন। তবে এতে কতগুলো ধাপ অনুসৃত হবে।আর, সেগুলো হলো;
প্রথমত: নতুন শিক্ষাক্রম ও পেশাগত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহন
করতে হবে।
দ্বিতীয়ত: নতুন শিখন ভাবনা, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, সময় এবং
ধৈর্য্য একান্ত প্রযোজন হবে। কোন দ্রুত ব্যবস্থা এবং সহজ-সরল পন্থা এতে ফলাফল বয়ে
আনবে না।
তৃতীয়ত: শিক্ষার্থীরা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আবেগগত বিবেচনায়
তাদের শিখনে নিয়োজিত হবে। এক্ষেতে শিখন-শেখানো মূল্যায়ন হবে অপর্যাপ্ত। এক্ষেত্রে
আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া প্রযোজ্য হবে না।
চতুর্থত: যেহেতু আমাদের সামাজিক ও তথ্য-প্রযুকক্তিগত
প্রবণতাগুলো নিত্যই বদলাচ্ছে, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন ও সাম্প্রতিক-অর্থনৈতিক
প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষিতে । তাই ভবিষ্যত শিখনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়ার স্বার্থে
শিক্ষাদান ও মূল্যায়নের ধরণেও পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
উপসংহার: একবিংশ শতাব্দীর উপযোগি শ্রেণি শিখন হবে, দূরদর্শী, এর
প্রতিফলন ঘটবে, শিক্ষা জীবন, কর্মজীবন ও বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক-জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক জীবনব্যাপী। শিক্ষকতায় নিয়োজিত যাঁরা; একবিংশ শতাব্দীর উপযোগি হয়ে
ওঠতে হবে, তাদেরকে। আর, ছাত্র/ছাত্রীদেরকেও হতে হবে অনুরূপ। শ্রেণি পাঠদান, উপকরণ
ব্যবহার, মূল্যায়ন প্রভৃতি সব কিছু হবে, শিক্ষার্থীর প্রয়োজনে এবং যুগোপযোগি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন