সুদক্ষ শিক্ষক
সমৃদ্ধ প্রাথমিক বিদ্যালয়
মোহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
সহকারি
উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী,
কক্সবাজার।
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সফল
প্রতিষ্টানে রূপ দানের জন্য প্রয়োজন, একদল সুদক্ষ এবং সুযোগ্য শিক্ষক। আর তা
প্রয়োজণীয় সংখ্যক হতে হবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক না থাকলে, শিক্ষার্থীরা
মারাত্নকভাবে বঞ্চিত হয়। ক্ষতি হয়, মানসম্মত শিক্ষা। আবার অতিরিক্ত শিক্ষক থাকলেও,
অনেক বিদ্যালয় ভাল করে না। অতিরিক্ত শিক্ষক বা কম শিক্ষক যাই হোক না কেন, মানসম্মত
বা দক্ষ শিক্ষক না থাকলে, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন কিছুই নেই, মনে হয়।
বিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমও ভাল হয় না। সুতরাং, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে উত্তম
বিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে, প্রথমেই প্রয়োজন একটি দক্ষ ও
যোগ্য শিক্ষক/শিক্ষিকার দল। এ দলের প্রত্যেক সদস্য যদি দলীয় চেতনা, নিষ্ঠা,
আন্তরিক ও সক্রিয় হয়ে কাজ করেন, তবে সে বিদ্যালয়ের সাফল্য কেউ আঁটকে রাখতে পারবেন
না, পারছেন না। আর বাংলাদেশের দরকার এ রকম সুদক্ষ শিক্ষক দল ও প্রাথমিক বিদ্যালয়।এ
নিবন্ধে শক্তিশালী শিক্ষক দল গড়ে তোলে কীভাবে একটি বিদ্যালয়কে সাফল্যের স্বর্ণ
শিখরে নিয়ে যাওয়া যায়, তার কিছু কৌশল নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
ভাল
শিক্ষক সমৃদ্ধ বিদ্যালয় গড়ে তোলার কৌশলসমূহ: সূচনা বক্তব্যে, আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, কোন্ স্কুলকে আমরা ভাল
স্কুল বলব। একটি বিদ্যালয়ে বেশি শিক্ষক বা কম শিক্ষক থাকা কোন বিষয় নয়, পশ্ন হচ্ছে
যাঁরা আছেন, তাঁরা কতটা দল হিসেবে সমৃদ্ধ এবং সুদক্ষ। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি
শিক্ষক আছেন, এমন বিদ্যালয়ও আছে এবং কম শিক্ষক আছেন এমন বিদ্যালয়ও আছে।যাহোক, একটি
বিদ্যালয়কে শক্তিশালী করার জন্য নিন্মোক্ত কৌশলগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে।
১.চাপ প্রয়োগ নয়, স্বকীয় ঐক্যই শক্তি: আমাদের দেশে, ওপর হতে উপজেলা
শিক্ষা অফিস পর্যন্ত কর্মরত কর্মকর্তা-কতৃপক্ষ সকলেই একটি বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষকের উপর চাপ সৃস্টি করে থাকেন বিভাগীয় বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়নের
জন্য। সেটা হতে পারে একাডেমিক বা প্রশাসনিক। আর প্রধান শিক্ষকগণ চাপ সৃস্টি করেন,
সহকারি শিক্ষকদের উপর তা আদায় করার জন্য। এভাবে কাজ করা হয়, মূলত আনুগত্য
প্রকাশমূলকভাবে। কিন্ত সামগ্রিকভাবে বিদ্যালয়টি শক্তিশালী বা সাফল্য পাচ্ছে বলে,
মনে হয় না। সুতরাং উন্নত-উন্নয়নশীল সব দেশে বিদ্যালয়গুলোকে এক ধরণের স্বায়ত্ত্ব
শাসন দেয়া হচ্ছে। শিক্ষকগণ স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র নিয়ে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন
করবেন।শিক্ষার্থীদের সার্বিক মঙ্গলের জন্য শিক্ষকগণই সিদ্ধান্ত নিবেন, তাদের
পাঠ্যসূচি হতে শুরু করে পরীক্ষা গ্রহণ এবং মানসম্মত একটি শিশুকে তৈরি করে তোলে
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সফলভাবে উৎরে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু শিক্ষকগণ
নিজেদের মত করবেন।আর শিক্ষকগণই তাঁদের প্রয়োজনে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নিকট হতে যে
কোন সহযোহিতা নেবেন। আর শিক্ষকগণ স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে
যাবেন। কারও চাপা-চাপিতে কেহ কাজ করলে, তাতে তেমন সাফল্য আসে না।
২.শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে শিখণ এবং শিক্ষকদের অব্যাহত শিখণ
চর্চা: একটি শিক্ষকসমৃদ্ধ বিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ, যৌথভাবে বিদ্যালয়ের
সাফল্য-ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব বহন করার মানসিকতা পোষণ করবেন। সবার মাঝে এ চেতনা বোধ
কাজ করবে যে, এটা আমাদের বিদ্যালয়, আমরাই এর সাফল্য-ব্যর্থতার ভাগিদার। আমরা সবাই
শিক্ষার্থীদের মানুষ করছি, উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শন করাচ্ছি এবং স্বপ্ন পূরণ
করানোর জন্য এর দ্বার-প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বর্তমানে
কর্মরত সহকারি শিক্ষকগণ, বিদ্যালয়ের সব দায়-দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকের ওপর চাপিয়ে
দিয়ে তাঁরা এমন মনোভাব নিয়ে চলেন যে, বিদ্যালয়টি জাহান্নমে গেলেও তাঁদের কিছু করার
নেই। উর্ধ্বতন কেহ তাঁদের বিদ্যালয়ে আসলে, প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে কোন
সহকারি শিক্ষক বিদ্যালয়ের কোন দায়-দায়িত্ব নিতে চান না, কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করেন
না। আর তাঁরা মনে করেন যে, অন্যান্য চাকুরির মতো তাঁরাও একটি চাকুরি করছেন, মাস
শেষে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। আবার প্রধান শিক্ষকগণও বিদ্যালয়ের সবকিছু তাঁর দখলে রেখে
দেন এবং সহকারি শিক্ষকদের কোন কিছু বুঝতে দেন না। এতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আসলে
যেটা হওয়া উচিত এধরণের ভাবনা পরিহার করে সবাইকে এক হয়ে কাজ করা।বিদ্যালয়ে ভর্তি
হওয়া এবং অধ্যয়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মঙ্গলের জন্য যা করার করতে হবে। সবাইকে
সাফল্য-ব্যর্থতার দায় বহন করতে হবে।
৪. মানসম্মত শিক্ষকের ব্যাপারে কোন আপোষ করা চলবে না: একটি বিদ্যালয়ে
কর্মরত শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ের প্রবীণও জ্যেষ্ঠ সহকর্মীকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
হ্যাঁ তাঁরা এ জন্য আলাদা মর্যাদা পাবেন, বটে। কিন্তু সফল পাঠদান ও শিখণ-শেখানো
কাজে সুদক্ষ একজন শিক্ষক; যদি একদম নবীনও হন, তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে।
নবীন-প্রবীণ সবাই একটি দলীয় চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে পরস্পরের সহযোহিতায় পেশাগত যোগ্যতা
ও দক্ষতায় উন্নত হয়ে কাজ করাই সবচেয়ে ভাল। আর যাঁরা নিজেদেরকে পেশাগতভাবে উন্নত
করার ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, তাঁদের সুরক্ষা দেয়া বা সমর্থন দেয়া
যাবে না। নবীনই হোক, আর প্রবীণই হোন, শিক্ষক হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব বা সুদক্ষতার পরিচয়
ফুটিয়ে তুলতে হবে। অন্য কিছু নয়।
৫. শিক্ষার্থীদের সাফল্য ও মূল্যায়নের নব নব ধ্যান-ধারণাগুলোকে ধারণ করেতে
হবে: সুদক্ষ শিক্ষক সমৃদ্ধ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যা কিছু জানানো উচিত এবং
শিখাতে হবে, তার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকগণ যত ধরণের কৌশল অবলম্বন
করতে হয় করবেন এবং শিক্ষার্থীদের উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অব্যাহত চেষ্টা
চালিয়ে যেতে হবে। সেকলে সব কলা-কৌশল এবং ভাবনার মাঝে ঘুর-পাক খাওয়া চলবে না। নতুন
নতুন কৌশলে আমাদের যুগের শিক্ষাথীর্দের চাহিদা পূরণের জন্য যা করার করতে হবে।
সাধারণত আমরা বিদ্যালয়গুলোতে যা দেখি, কর্মরত শিক্ষকগণ কখন, কবে এস.এস.সি,
এইচ.এস.সি, ডিগ্রী পাশ, এমএ পাশ করেছেন এবং পেশাগত সনদ নিয়েছেন সি-ইন-এড,
ডি.পি-এড, এম-এড, বি-এড; এগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ খেকে যান। আজকের যুগের শিক্ষকদের
জন্য এসবই যথেষ্ট নয়। একটি বিদ্যালয়ে কর্মরত সহকর্মীগণকে পরস্পরের সহযোগিতায় নতুন
নতুন শিখণ-শেখানো কৌশলগুলো আয়ত্ব করে নিতে হবে। তাঁরা কৌতূহলী হবেন, খোলা মনে
নিত্যই শিখবেন এবং সবাই সমৃদ্ধ হবেন।
এতক্ষণ একটি সুদক্ষ ও সমৃদ্ধ শিক্ষক
সম্বলিত বিদ্যালয় সম্পর্ক আলোচনা করলাম। আর একটি বিদ্যালয়কে সফল করে তোলার জন্য
কিছু কৌশল উল্লেখ করেছি। আসলে একটি বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক বা একবারে কম শিক্ষক
থাকলেই কোন বিদ্যালয় সফল বা বিফল হয়, এটা অবান্তর বিতর্ক। দরকার হলো, বিদ্যালয়কে
সফল করে তোলা। এজন্য প্রয়োজন প্রত্যেক শিক্ষককে সুদক্ষ ও সুযোগ্য হওয়া এবং
শক্তিশালী দলীয় চেতনা ও নিরন্তর কাজ করে যাওয়া। আসুন, আমরা সবাই চেষ্টা করি এবং
প্রত্যেক বিদ্যালয়ের সাফল্যের জন্য এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মানসম্মত শিশুতে
পরিণত করার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়কে শিক্ষক সমৃদ্ধ বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন