শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫

Primary Education in India and Bangladesh

ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা:
বাংলাদেশের শেখার আছে কী?
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা; যে কোন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সমৃদ্ধির জন্য চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে।বিগত কয়েক দশক ধরে ভারত তার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তুলেছে। ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভরেতের ৯৫ শতাংশ জনগণের জন্য প্রতি কিলোমিটারে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।তাদের ২০১১ সালে, গ্রাম এলাকায় বিদ্যালয়ে শিশুর ভর্তি হার ছিল ৯৩%। তবে, ভারতের শিশুদের শিখন ফল অর্জনের মাত্রা তেমন ভাল নয়।একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী মূল্যায়ন সমীক্ষায় ৬৪ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬৩ তম।যদিও তাদের কিছু কিছু বিদ্যালয় বেশ উন্নত মানের।২০১১ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে, ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৪৮.২% পড়তে পারে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেছে, এমন শিক্ষার্থীদের গাণিতিক ও ভাষাগত যোগ্যতা অর্জনের মান তেমন ভাল নয়। ভারতের বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো এবং শহর এলাকার ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা নগন্য। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ ভারতীয় শিক্ষার্থী সরকার পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে থাকে। ২০০৮-২০০৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ি ৮৭% গ্রামীণ ভারতের শিশু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকে।
ভারতের প্রাথমিক শিক্ষায় বৈচিত্রময় সমস্যাসমূহ: ভৌগোলিক ও জাতিগত বৈচিত্রতার কারণে ভারতের প্রাথমিক স্তরের শিশদের শিখন ফল বা যোগ্যতা অর্জন আশাব্যঞ্জক নয়। এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম গল্প, দুর্বল শিক্ষাদান পদ্ধতি।গ্রামীণ ভারতে শিক্ষকতা একটি কঠিন কাজ। একই শিক্ষককে বহু বিষয় ও বহু শ্রেণিতে পাঠদান করতে হয়।পাঠ্যপুস্তকগুলোও শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্বোধ্য এবং বিভিন্ন মেধার শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহন করে থাকে। শিক্ষকদের চাকুরিপূর্ব এর্ চাকুরিকালীন প্রশিক্ষণ সুবিধা কম এবং শিক্ষকদের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠতে পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা নেই।এতে বুঝা যায়, প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকের শিক্ষাদানের মান দুর্বল। ২০০৮-২০০৯ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ি এসব শিক্ষকের ৪৫% শতাংশের যোগ্যতা ছিল এইচএসসি।তাছাড়া, উন্নত পেশাগত মান অর্জন করে ও পেশাগত উৎকর্ষতা নিয়ে শিক্ষকতা করার মত উদ্যম শিক্ষকদের মধ্যে তেমন পরিলক্ষিত হয় না। শিক্ষকদের একটা অংশ বিদ্যালয় কার্যক্রমে অংশগ্রহনের ব্যাপারে আন্তরিক ও সক্রিয় নন। তাদের ২৫% শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন।ভারতের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে প্রতি বিদ্যালয়ে গড়ে ৩ জন করে শিক্ষক উপস্থিত থাকেন।২০০২-০৩ সালে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ি রাজস্থানের একটি বিদ্যালয়ের চিত্র পাওযা যায়, এভাবে যে, কর্মরত ৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩ জন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন। আর ৫ জন শিক্ষক ৮ টি শ্রেণিতে পাঠদান করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন।ভারতে কর্মরত শিক্ষকদেরকে বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, ভাল।তুলানামূলকভাবে তাঁদের অবস্থা চীন ও ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষকদের  চেয়ে ভাল। সুতরাং বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়টি শিক্ষকদের শিক্ষাদানে তেমন অন্তরায় নয়। কিন্তু, কর্মরত শিক্ষকদেরকে শিক্ষাদান ছাড়াও অন্য অনেক কাজ করতে হয় বলে, তাদেরকে কঠোর পরিশ্রমে লিপ্ত হতে হয়।টিকাদান, আদম শুমারি, স্বাস্থ্যসেবামূলক, ভোটার তালিকা তৈরি ও ভোট গ্রহনের কাজসহ বিভিন্ন প্রকার কাজে শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করায় এসব কাজে শিক্ষকদেরকে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে হয়।এছাড়া, শিক্ষকদেরকে স্থানীয় প্রশাসন সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে বলে, তাঁরা নিজেদের মত করে বিদ্যালয় পরিচালনায় কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারেন না। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষায় অন্যতম আরেকটি অন্তরায় হলো, মুখস্থকরণ পদ্ধতি। শিক্ষার্থীরা একই বিষয় বার বার না বুঝে মুখস্থ করতে থাকে। শিক্ষকগণও মুখস্থকরণের ওপর জোর দিয়ে থাকেন। নতুন শব্দের সাথে পরিচিতি বা অর্থ বুঝা, বিষয়বস্তু বুঝা, বিষয়ের শিখন ফল অর্জন, সমস্যা সমাধান, মর্মার্থ বুঝা ইত্যাদি সব বিষয় বুঝার প্রচেষ্টা না করে শুধু মুখস্থ করানোর ফলে শিক্ষার্থীদের কাংখিত যোগ্যতা অর্জন হয় না। ভারতের আরেকটি বড় সমস্যা হলো সেখানকার বিবিধ জাতি-উপজাতির বসবাস এবং তাদের স্থানীয় উপভাষা। শিক্ষকের পাঠদানের ভাষা এবং শিশুদের মাতৃভাষা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে পাঠের শিখন ফল এবং বিষয়বস্তু আত্নস্থ করা শিক্ষার্থী-েশিক্ষক উভয়ের জন্য খূব কঠিন প্রকিয়ার মধ্য দিয়ে এগুতে হয়।এতে শিক্ষকদেরকে ক্ষেত্র বিশেষে স্থানীয় ভাষায় শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু বুঝতে সহায়তা করতে হয়।পল্লী এলাকার শিক্ষার্থীদেরকে ছোট-খাট ইংরেজি একটি বাক্য শিখতেও হিমসিম খেতে হয়। মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাস্তরেও ভারতে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিখনের মানও কাংখিত পর্যায়ের নয়। ১৯৮০-এর দশকে ভারত সরকার বেসরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে উৎসাহিত করে।বিগত কয়েক দশকে এ ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়েছে।তবে এ ধরণের বিদ্যালয়ের সংখ্যা এখনও কম। মাত্র ১৩৫ শিশু এসব বিদ্যালয়ে পড়তে যায়। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংক্যা কম বটে, গ্রামীণ ভারতে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার মান ভাল। বিহারসহ কোন কোন রাজ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মান বেশ ভাল। বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগেও কোন কোন রাজ্যে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
সরকারি –বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ: ভারতে বিগত কয়েক দশকে অনেক বেসরকারি সংস্থা; সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিক্ষকগণের মানোন্নয়নে যৌথ কর্মসূচি গ্রহন করেছে। ইউনিসেফ, পৌরসভাসহ বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণি পাঠদানের মানোন্নয়ন, পাঠাগার গড়ে তোলা এবং শিক্ষা উপকরণসহ অন্যান্য সরঞ্জমাদি সরবরাহ করছে। তাছাড়া, গ্রাম এলাকার শিক্ষার্থীদের গাণিতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ইংরেজি বিষয়ের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বিশ্বব্যাংক ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ভারত সরকারকে।
ভারতের প্রাথমিক শিক্ষার ভবিষ্যত: বিগত ৩ দশকে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় নাটকীয় অগ্রগতি হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় এবং তাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি শতভাগে উন্নীত হয়েছে।শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা দেযা হচ্ছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক আইন করার কারণে পূর্বের চেয়ে শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা বয়ে এনেছে। যাহোক, ভারতের কেন্দ্রিয় সরকার, রাজ্য সরকার, অঞ্চল বিশেষ, সংর্স্কৃতি এবং আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রাথমিক শিক্ষার কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছা কঠিন ব্যাপার। বিশ্ববাজারে ভারত, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শক্তির বিবেচনায় বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম শক্তি। এর বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে খুব পিছিয়ে নেই। সার্বিক বিবেচনায় ভারত আগামীতে শিক্ষার উন্নয়নে আরও ভাল করবে, সন্দেহ নেই।
ভারত-বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় মিল-অমিল: ভারত একটি বিশাল দেশ। ২৬ টি রাজ্য নিয়ে এ দেশ। জনসংখ্যা ১৫০ কোটির কাছাকাছি। আর বাংলাদেশ তাদের একটি রাজ্যের সমান একটি দেশ। জনসংখ্যা ১৬ কেটির মত। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা অঞ্চল বিশেষে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত হলেও সামগ্রিকভাবে তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। শিক্ষাদান ও শিখন-শেখানো কার্যক্রমের মান কোথাও কোথাও আমাদের চেয়ে হয়ত খারাপ। কিন্তু ইংরেজি ভাষা শিখন ও গণিত এবং বিজ্ঞান বিষয়ে শিখন বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভাল। তাছাড়া, তাদের শিক্ষা নীতি, শিক্ষাক্রম ও বিদ্যালয় পরিচালনা ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত।
উপসংহার: উপরে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষাচিত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘লিডরিশীপ ক্লাস ২০১৫’ নামক একটি সংগঠন কতৃক উপস্থাপিত একটি নিবন্ধ হতে বর্তমান নিবন্ধের তথ্য-উপাত্ত নেয়া হয়েছে। এতে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বেশ কিছু দুর্বল দিক ফুটে ওঠলেও, তা বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ নয়। তবে বিবেচ্য কিছু দিক হলো, সে দেশের শিক্ষকগণ বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি পান। সর্বোপরি, বর্তমান নিবন্ধটি পড়ে প্রাথমিক স্তরে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ এ নিবন্ধ হতে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন