বাংলাদেশের
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
কমরর্ত
শিক্ষক এবং তাঁদের জীবন-মান
বাংলাদেশে প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের অধিকাংশই খুব কষ্টে জীবন-যাপন করে যাচ্ছেন। তাঁদের পদ
মযার্দা এবং প্রদেয় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা মোটেই পযার্প্ত নয়। অন্যান্য
চাকুরিজীবী এবং পেশাজীবীরা তাদের চেয়ে অনেক স্বচ্ছল ও স্বাচ্ছন্দ জীবন-যাপন করে
থাকেন। অনেক দিন ধরে শোনানা যাচেছ, সরকার তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে
চলেছে। এ সিদ্ধান্ত যত দ্রুত সম্ভব বাসতবায়ন করা হবে, ততই মঙ্গল।অন্যান্য
অফিসগুলোতে সাধারণ মানের কর্চারিরাও তাদের তুলনায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি
পান। তারা দৈনন্দিন পারিবারিক-সামাজিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে অত্যন্ত হিমশিম খাচ্ছেন।
অনেকে ধার-করজে পড়ে নাস্তা-নাবুদ হয়ে আছেন। না পারছেন চাকুরি ছাড়তে, না পারছেন,
ন্যুনতম মান-সম্মান রক্ষা করে জীবন-মান অক্ষুন্ন রাখতে। যাহোক, এ নিবন্ধে প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে কমরর্ত শিক্ষকদের জীবন-মান নিয়ে আলোকপাত করা হবে। এটা কোন গবেষণাপত্র
নয়, বরং প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের সদস্য হিসাবে ১৫ বছর ধরে কর্মরত থাকার অভিজ্ঞতার
বণর্না মাত্র।
বিদ্যমান পরিস্থিতি: একজন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক তার শিক্ষকতা জীবন বেছে নিয়েছেন,
তার মধ্যে সততা ও নিষ্ঠাবান জীনের আকরষণ বোধ আছে বলেই। তিনি অন্য যে কোন পেশায়
যেতে পারতেন। হতে পারতেন কেরানি, মুন্সি, পুলিশ, কোন বাহিনীর অফিসার বা সৈনিক অথবা
করতে পারতেন অন্য যে কোন সরকারি-বেসরকারি চাকুরি। এত পেশা থাকতে তিনি শিক্ষকতাকে
বেছে নিয়েছেন, তার মনের মণিকোটায় পবিত্রতা ও স্বচ্ছ জীবন-যাপনের আকাংকা আছে বলে।
তারা অন্য কোন পেশাজীবীর চেয়ে কোন মতেই কম যোগ্য নন। তারা, পুরুষ হলে কমপক্ষে
স্নাতক ডিগ্রী পাশ। মহিলা হলে ন্যুনতম এসএসসি সি-এন-এড পাশ। বিশেষত বিগত ১০/১৫
বছরে যারা শিক্ষকতায় এসেছেন, তারা অনেকেই অনার্সহ মাস্টার্স পাশ। আবার অনেকে
বি-এড, এম-এড পাশ। অনেকের আবার আইনের ডিগ্রী এবং প্রযুক্তিগত যোগ্যতা ও দক্ষতার
সনদ রয়েছে। কিন্তু সৎ মানসিকতা তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় টেনে নিয়ে
এসেছে। আর এখানে এসে দেখতে পান যে, প্রতিদিন বিদ্যালয় গমনাগমন, পরিবারের দৈনন্দিন
চাহিদা মেটানো, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ দেয়া, বৃদ্ধ বাবা-মার ভরণ-পোষণ এবং
অসুস্থদের চিকিৎসা খরচ যোগাতে গিয়ে রীতিমত দেউলিয়া হয়ে পড়েন। ফলে, একজন শিক্ষকের
নিকট থেকে জাতি যা প্রত্যাশা করে তা পুরোপুরি তার কাছ থেকে পাওয়া অনেক ক্ষেত্রে
অসম্ভব প্রায়।
সমস্যাসমূহ: গ্রামে-গঞ্জে-শহরে বাড়িতে থেকে বা ভাড়া বাসায় থেকে প্রাথমিক
স্তরে শিক্ষকতা হতে পারত একটি সম্মনজনক পেশা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে
জীবনযাত্রার ব্যয় ও আয়ের ফারাকটা এত বেশি বেড়ে গেছে যে, তারা মোটেই পেরে ওঠছেন
না।একজন শিক্ষক বেতন-ভাতা যা পান, শুধু তাই তার অবলম্বন এবং তা পযার্প্ত নয় বলে,
তাকে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, প্রতিনিয়ত।৮০ হতে ৯০ শতাংশ শিক্ষক খুব কষ্টে
আছেন। তাদেরকে ছোট করার জন্য বলছি না, নিজে শিক্ষক পরিবারে সাথে ওঁতোপ্রোতোভাবে
জড়িত থাকা এবং এক ঝাঁক নিকটাত্নীয়-স্বজন শিক্ষকতা করছেন, যাদেরকে খুব কাছ থেকে
দেখে আসছি; সে উপলব্ধি থেকে বিষয়গুলো নিয়ে লিখছি।অবশিস্ট কিছু শিক্ষক আছেন, যারা
পারিবারিক স্বচ্ছলতা বা বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া সম্পদের সহায়তা পেয়ে কিছুটা ভাল
আছেন, হয়ত। আবার কিছু শিক্ষক আছেন, বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময়ের আগে-পরে টিউশনী করে
বাড়তি কিছু আয় করতে পারেন।আবার কেহ কেহ পারিবারিক ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা কাজে
সময় দিয়ে কিছুটা বাড়তি আয় করে বেতন-ভাতা যা পান সমন্বয় করে স্বাচ্ছন্দে আছেন। তবে
বেশির ভাগ শিক্ষকই জীবনযাত্রার মানটাকে ধরে রাখতে পারছেন না। সারা মাস ধার-কর্জ
করে চলেন, বেতন-ভাতা পেলে, দোকান বাকি পরিশোধ করতেই ৭০ হতে ৮০ ভাগ টাকা চলে যায়।
অবশিস্ট টাকা দিয়ে পুরো মাস অন্যান্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হন না; একজন সাধারণ
মধ্যবিত্ত বা নিন্ম মধ্যবিত্ত শিক্ষক। জনৈক উপজেলা পযার্য়ের প্রশাসককে (যিনি এখন
একটি জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) একবার বলতে শুনেছি, শিক্ষকদের পরিবারকে স্বয়ং
আল্লাহ তায়ালা বা ভগবান দেখাশোনা করে থাকেন, নাহলে তারা এ দেশে বেঁচে থাকতে পারতেন
কিনা সন্দেহ। কথাটি খুব খাটি কথা। কারণ, শিক্ষক জীবনটা কাটিয়ে দেন অন্যদের
সন্তানদের মানুষ করে, নিজেরগুলোকে পড়ানো তো দূরে থাক, ভালভাবে খোঁজও নেয়ার সুযোগ
পান না।কিন্তু সমাজে আজ যারা সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই হয়তো
শিক্ষকের সন্তান অথবা সে শিক্ষকের উত্তরসূরি।যাহোক, লিখছিলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
শিক্ষকদের দূদর্শার কথা। অধিকাংশ শিক্ষককে প্রতিদিন বিদ্যালয় গমনাগমন করতে হয় বেশ
দূর এলাকায় এবং তাদেরকে কোন না কোন যানবাহনে চড়তে হয়। ফলে, তাঁর গাড়ি ভাড়া,
খাবার-দাবার খরচ পুষিয়ে ওঠা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা
করা ও তাদের আবদার-অনুরোধ রক্ষা করা এবং অনুষ্ঠনাদিতে অংশগ্রহন ইত্যাদি
বাঙ্গালীয়ানা বজায় রাখা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে
পড়েছে।
সুপারিশমালা: বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালযগওলো চলে পুরোপুরি সরকারি খরচে।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, পেশাগত বিভন্ন ধরণের
প্রশিক্ষণ আয়োজন, বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, মেরামত-সংস্কার; সব সরকার করে থাকে।
কিন্তু পড়াশোনাও চলে সম্পূর্ণ বিনা বেতন। বিনামূল্যে শিশুদের শতভাগ পাঠ্য বই দেয়া
হয়। কোন রকম ফি আদায়ের বিধান নেই। শুধু পরীক্ষা ফি নেয়া হয়। দরিদ্র শিশুদের
পড়াশোনা, শতভাগ ভর্তি, ঝরে পড়া রোধকরণ এবং প্রত্যেক শিশুর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত
করার জন্য সরকার মিড-ডে মিল, উপবৃত্তি সুবিধাসহ অনেক কিছু দিচ্ছে। কিন্তু যৎ সামান্য
বেতন-ভাতায় র্রমরত সাধারণ ও আথির্কভাবে দুবর্ল শিক্ষকদের জীবন-মান উন্য়নে
সহানুভূতি নিয়ে ভবাবার অবকাশ পাচ্ছে না। এটা হয় না। তাদের জন্য বিশেস প্যাকেজ
সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবতে হবে। শুধু বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করলে হবে না। প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য অন্যান্য চাকুরিজীবীদের ন্যায় যাতায়ত ভাতা, বাড়ি ভাড়া,
বিদ্যালয়ের খরচ মেটানো, প্রশিক্ষণ ইত্যাদিতে ভাতা বৃদ্ধিসহ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা এবং
সেই সাথে তাদের পদ মযার্দা উন্নীত করতেই হভে। অন্যথায়, সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা;
‘প্রত্যেক শিশুর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ” বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সে আশায়
গুঁড়ে বালি হয়ে থাকবে।
উপসংহারে বলতে হয়,
প্রাথমিক বিদ্যালযে কর্মরত শিক্ষকদের মন ভাল নেই, আজ। তাদের মযর্দা বাড়াতে হবে।
সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করতে হবে। তারা সমাজে মান-সম্মান নিয়ে চলতে গিয়ে
অত্যন্ত হিমশিস খাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে তাদের জন্য এবং জাতি গঠনের
কারিগরদের সম্মান রক্ষার্থে আরও সহানভূতির সাথে গভীরভাবে ভাবতে হবে। তাদের জন্য
কিছু করতেই হবে। তাদেরকে ধার-কর্জের জীবন হতে রেহাই দিতেই হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
কমরর্ত শিক্ষকদের আমি অত্যন্ত গভীরভাবে
সমীহ, শ্রদ্ধা ও স্নেহ করি। তাদের নিয়ে কাজ করছি ১৫ বছর ধরে। তাদের সাথে একাত্ন
হয়ে গেছি। বলা যায়, আমি তাদের বন্ধু, শিক্ষক, সহকর্মী ও সহায়ক। আমরা সবাই এক
পরিবারের সদস্য। আমার লেখায় কেহ মনে কষ্ট পেয়ে থাকলে, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সবাই ভাল
থাকুন, সুস্থ থাকুন, দোয়া করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন