শিক্ষকতার নতুন সংজ্ঞায়ন:
এক বিংশ শতাব্দীর ভাবনা
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী,
কক্সবাজার।
বর্তমান বিশ্বে যে কোন প্রতিষ্ঠানে
বা সংগঠনে তাদের কর্মী বেচে নেয়, যারা উচ্চতর প্রেষনাসম্পন্ন, দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
ব্যক্তিত্ব, যিনি যোগ্য মর্যাদা বা পারিশ্রমিক পাওয়ার প্রত্যাশী; এমন সব গুণাবলিতে
গুণান্বিত, উন্নত সংস্কৃতিবান, কর্মঠ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিবর্গকে। শিক্ষকসহ সব
ধরণের কর্মী নিয়োগে প্রতিষ্ঠানে বা সংগঠনে নব উদ্যম, সৃজনশীল ও ব্যক্তিগত উৎকর্ষতা
ভাল ফলাফল বয়ে আনে। এভাবে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হোক বা অন্য কোন সংস্থাই হোক
শিক্ষকগণ বা কর্মীগণ তাঁদের সর্বোচ্চ মেধা নিয়োজিত করে কাজ করে যান।যুগের চাহিদা
হলো; ব্যক্তি বিশেষের সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও পেশাগত অঙ্গীকার; ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয়
সাফল্য বয়ে আনে।বিগত ১৫০ বছরের অধিক কাল সময়ে শিক্ষকতার বিকাশক্রম পর্যবেক্ষণ করলে
দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া এখন, নমনীয়তা, সমঝোতা, সুনাগরিকতা,
শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক, বিজ্ঞানসম্মত শিখন ফল, দৃশ্যমান ফলাফল অর্জন প্রবণতামুখি
হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনুসন্ধানমূলক ও মান যাচাই; এ দু‘য়ের মধ্যে কোনটি উত্তম; এ বিতর্ক
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং তা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। ঐতিহাসিকভাবে
শিক্ষকদের অবদান বা ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। অভিন্ন স্কুল বা শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের যুগে মহিলা শিক্ষকগণ, শিশুদের নৈতিক শিক্ষার উন্নয়নের ওপর জোর দিতেন।
অতপর, বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে শিশুদের আভিজাত্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হতো। আর
বর্তমান যুগে শিক্ষর্থীদের বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবেশন বা তথ্য
সমৃদ্ধ শিক্ষার্থী গড়ে তোলার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। বিগত ১০০ বছরে শিশুদের বিষয়
ভিত্তিক দক্ষতার ওপর যেমন- প্রকৌশল, চিকিসা, অর্থনীতি, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন
বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করা
হয়েছে।কিন্তু এখনকার চাহিদা হলো; বিশ্ব কর্মসংস্থান বাজরে প্রতিদ্বন্দ্বি
মনোভাবাপন্ন, উন্নত মানসম্মন্ন, অধিক শিখন সমৃদ্ধ, শিক্ষক কতৃক মূল্যায়নে
সনদপ্রাপ্ত কর্মী, যাঁরা মেধার বিনিময় কামনা করে এবং চাহিদা অনুযায়ি শিখণ-শেখানো
প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া মানব সম্পদ।
.
শিক্ষকতার নতুন কাহিনী: শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম না করে
এখনকার চাহিদা হলো, বড় পরিসরের কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে
গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন অর্থবহ শিখন ফল বেচে নিয়ে শিক্ষার্থীদের
সামনে উপস্থাপন করবেন। এসব বিষয় বস্তু হবে, সাধারণ, বস্তুনিষ্ঠ, ভবিষ্যতমুখি এবং
শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পাবে, এমন।এসব লক্ষ্য অর্জন যত বেশি
হৃদ্যতাপূর্ণ হবে, তত বেশি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটবে। এভাবে বৈশ্বিক-দূরদর্শী
শিক্ষার্থী গড়ে ওঠবে।
.
শক্তি, সৌন্দর্য্য এবং বর্তমান
মুহুর্তের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রশংসাকরণ: একজন শিক্ষক নিজেকে অতি ঈর্ষণীয়, চ্যালেঞ্জিং, একুশ শতকের
চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম এমন ভাবে তৈরি করে তুলবেন। তিনি এমন করে ভূমিকা পালন করবেন
যে, শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি হবেন, সহ-স্রষ্টা, যা কেউই ভাবতে
পারে না এবং অজানা মহা সমুদ্রে নতুন প্রজন্মের সহায়ক। কিন্তু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত
হবে আবিস্কৃত ও তিনি হবেন, এর অংশ। শিক্ষকের অকৃত্রিম ভালবাসা, দর্শন ও মহত্বের
অনুভূতি তাঁর অবদানের পরিমাপক নির্দিষ্ট করে দেবে, কিন্তু সে গুণাবলি প্রকাশিত হবে
প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে। শিক্ষকের সুবিধার জন্য যত বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
পাবে, শিখন-ফল তত ভাল হবে এবং কাজটিও তত বেশি আনন্দদায়ক হবে। একইভাবে শিক্ষার্থীরও
তাই হবে।
.
বৈশ্বিক দর্শনে অবদান রাখা: চাকুরির নিরাপত্তা ও চাকুরি সন্তুষ্টির
জন্য প্রতিদান ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নিজ দক্ষতা-যোগ্যতাকে সীমাবদ্দ গন্ডির
মধ্যে গুটিয়ে রাখাটা হবে, সংকীর্ণতা। এ সংকীর্ণতা পরিহার করে ভাবুন; কী করে দেশের
হাজার হাজার শিশুকে দারিদ্র্য চক্র হতে মুক্ত করবেন, কর্মসংস্থান পেতে সহায়তা
করবেন, পরিপূর্ণতা অর্জনে তাদেরকে এগিয়ে দেবেন এবং তাদের বসবাস উপযোগি বিশ্বকে তাদের
সামনে উপস্থাপন করবেন। মনে রাখতে হবে শিক্ষককে যে, বিশ্বব্যাপী বিশ্বাস বা দর্শনে পরিবর্তন
ঘটে গেছে। সর্বত্র শিক্ষকের উদ্বেগ বদলে গেছে ও প্রত্যেক দূরদর্শী শিক্ষকের অবলোকন
ক্ষমতা, নিজ গন্ডির বাহিরে চলে গেছে, কিন্তু বৈশ্বিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কর অন্তর্ভুক্ক
হয়ে পড়েছেন, শিক্ষার্থীদের কাতারে। এটা এক মহৎ উদ্যোগ।
.
কর্মতৎপর বা স্মার্ট শিক্ষকের নব পরিচিতি: পুরনো ধ্যান-ধারণায় সমৃদ্ধ শিক্ষকের
ভাবমূর্তি বদলে গেছে। কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী খুবই সহায়ক, কিন্তু
বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুনত্ব বা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সাফল্য বয়ে আনার জন্য তা
যথেষ্ট নয়। পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন কর্মসংস্থান বা মর্যাদা অর্জনে সহায়ক বটে,
কিন্তু এগুলো ছাড়াও আজকের যুগে অন্য অনেক কিছুর অপরিহার্যতা রয়েছে। এযুগের স্মার্ট
বা কর্মতৎপর মানুষ হতে হলে প্রয়োজন, অধ্যবসায়, সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য, অন্যের ভাবানা
বুঝা, কৌতূহল, উন্মুক্ততা, সৃজনশীলতা ও ভাবনার মূল্যায়ন। শিক্ষার্থীরা যে এখন
অন্যদেশ বা অন্যন্য খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিখন-শেখানোসহ সকল কার্যক্রম
অবহিত হয়ে যায়, তা বিবেচনায় রেখে শিক্ষককে শিক্ষা দানের কৌশলসমূহ আয়ত্ত্ব করে নিতে
হবে। অনেকে হয়ত আগের যুগের মত ভাবেন যে, শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষকদের বাইরে
অন্যদের ভাবনাও শিখন-শেখানো পদ্ধতি জেনে নেয়।
.
সহযোগিতামূলক বাস্তবাবতার সথে বাঁচতে
শিখুন: উন্নত বা
স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের ওপর দায়িত্ব-কর্তব্যের চাপও
অত্যধিক। আর তা সম্পাদন ও সহজ নয়। পেশাগত মায়া-মমতা এবং দৃঢ় অঙ্গীকারও এতে যথেষ্ট
নয়। এরকম পরিস্থিতিতে যা করতে হবে, তা হলো অন্যকে নিজের ভাবনায় বা কাজে
অংশীদারকরণ, ব্যক্তিগতভাবে বা অন্য উপায়ে। ফেসবুক, টুইটার, লাইন, ভাইভার প্রভৃতিতে
যুক্ত হয়ে অন্যদের ভাবনাগুলো জেনে নিয়ে নিজের করে নেয়া, এমন একটি কৌশল হতে পারে।
দৈনন্দিন পরিবর্তন ও সারাবিশ্বের উন্নত শিক্ষাদান ভাবনা ও কৌশলগুলো বুঝতে চেষ্টা
করতে হবে। নিজের ভাবনা বা জানা বিষয়গুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিন। আর অন্যদেরগুলো
নিজের করে নিতে হবে,শিক্ষকদের। এভাবে হয়ে যান বিশ্ব শিক্ষক, আন্তর্জাতিক শিক্ষক।
নিজেকে প্রতিষ্ঠা করুন, উচুঁ মর্যাদার-মানের।
.
উপরে
বর্ণিত ষিক্ষকতার নতুন বিন্যাস বা সংজ্ঞায়ন সম্পর্কিত ধারণাগুলো মার্কিন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী
থম মার্কহ্যামের। শিখন-শেখানোর নতুন নতুন কৌশল, শিক্ষার্থীদের শিখন ভাবনা এবং
শিক্ষা জগতের বিশ্বব্যাপী নতুন সব ধ্যাণ-ধারণা এবং বাংলাদেশে অনুসৃত সাম্প্রতিক
প্রবণতাসমূহ আমার নিবন্ধগুলোতে তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের
প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের সদস্যগণ এ নিবন্ধের মাধ্রমে বেশ উপকৃত হবেন বলে, আমার
বিশ্বাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন