প্রফেসর হাওয়ার্ড
গার্নার ও বহুমুখি শিখন পদ্ধতি
মোহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
সহকারি
উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী,
কক্সবাজার।
মর্কিন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর
হাওয়ার্ড গার্নার প্রাথমিক শিক্ষায় একটি সুপরিচিত নাম। তাঁর উদ্ভাবিত বহুমুখি শিখন
পদ্ধতি এবং বহুমুখি মূল্যায়ন নিয়ে আমরা বিগত ১০ বছরাধিক কাল ধরে কাজ করে আসছি। সে
আলোকে পাঠ-পরিকল্পনা তৈরি ও অনুসরণ করে শিক্ষকমন্ডলী সারাদেশে শ্রেণি পাঠ দান
কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।আর শিক্ষার্থীরা শিখন-শেখানো উপভোগ এবং শিখে আসছে। এ
পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রকাশনা সংস্থাগুলোও প্রচুর উপকরণ ও সহায়ক সামগ্রী বাজারে
ছেড়েছে ও বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা আরেক মার্কিন শিক্ষা
মনোবিজ্ঞানী বেনজামিন ব্লুমের যোগ্যতা ভিত্তিক পাঠ দান, উপকরণ ব্যবহার,
শিখন-শেখানো কৌশল অনুসরণ এবং মূল্যায়ন বা পরীক্ষা পদ্ধতি অবলম্বনের দিকে ধাবিত
হচ্ছি। যাহোক, আমরা কোন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীকে অনুসরণ করব, তাঁর একটি সুস্পষ্ট এবং
কার্যকর নির্দেশনা পেলে ভাল হয়।আমার মনে হয়, বাংলাদেশের স্বনামধন্য কিছু
শিক্ষাবিদ, শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং মাঠ পর্যায়ে কর্মরত
শিক্ষক-কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করে তাঁদের সবার মতামতকে সমন্য় করে
একটি অভিন্ন পদ্ধতি অনুরণ করাই উত্তম হবে।আর তা হবে, আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে এবং
আমাদের শিশুদের বয়স, সামর্থ্য এবং মেধা বা ধারণ ক্ষমতাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায়
নিয়ে। আমার আজকের নিবন্ধের বিষয় প্রফেসর হাওয়ার্ড গার্নার ও তাঁর বহুমুখি শিখন
পদ্ধতির ধারণা নিয়ে।
প্রফেসর হাওয়ার্ড গার্নার ও বহুমুখি শিখন পদ্ধতির
ধারণা: প্রফেসর হাওয়ার্ড গার্নার
১৯৪৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভানিয়া রাজ্যের স্ক্রেন্টনে জন্ম গ্রহণ
করেন।তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট স্কুল অব এডুকেশনের অধ্যাপক।১৯৯৫
সাল হতে তিনি ‘গুড প্রজেক্ট’ নামক একটি প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে
আসছেন। প্রফেসর গার্ডনার শিক্ষা, শিশু মন, শিশু মস্তিস্ক, শিশুর শিখণ কৗশল প্রভৃতি
নিয়ে শত শত গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন এবং ২০ টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন।তিনি বহুল
খ্যাতি অর্জন করেছেন; ‘ফ্রেমস অব মাইন্ড: থিউরী অব মাল্টিপল ইন্টেলিজেন্স’ বা
‘বহুমুখি শিখন পদ্ধতি ত্ত্ত্ব’ নামক গ্রন্থটি রচনা করে।ইহুদি বাবা-মায়ের সন্তান,
তিনি। তাঁর পরিবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে
অবিবাসিত হন।প্রফেসর গার্ডনারের ভাষায়, শৈশবে তিনি ছিলেন একজন অধ্যয়নশীল শিশু, যে
পিয়ানো বাজাতে খুব পছন্দ করত। গার্ডনার, পরে পিয়ানো বাদকের পেশা গ্রহন না করলেও
তিনি, ১৯৫৮ সাল হতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। তাঁর বাড়িতে
শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হত। তাঁর বাবা-মা আমেরিকার একটি বিখ্যাত স্কুলে
পড়াশোনার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্কুল পর্যায়ে পড়াশোনা করেন; একটি গীর্জা
পরিচালিত সেমিনারী স্কুলে।অনুসন্ধিৎসু ও মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবে তিনি তাঁর স্কুল
শিক্ষা সমাপন করেন। অতপর হাওয়ার্ড গার্নার মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের সবচেয়ে নাম করা
বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৬৫ সালে সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে
স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। উন্নয়ন মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পরে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন
করেন। এসময় তিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত সব অধ্যাপকের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং
তাঁদের নিকট পড়াশোনা করেন। তাঁর শিক্ষকদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন, অধ্যাপক এরিক
এরিকশন, রজার ব্রাউন, জেরোম বার্নার ও দার্শনিক নেলসন গুডম্যান।বোস্টনের প্রখ্যাত
এডনিস্ট্রেশন হস্পিটালে তিনি ২০ বছর ধরে কাজ করেন এবং সেখান হতে পোস্ট-ডক্টরাল
ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক হাওয়ার্ড গার্নার, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে
শিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন।তিনি, ১৯৯৫ সাল হতে আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যবস্থা বা
বিশ্বব্যাপী গ্রহনযোগ্য শিশু শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ক গুড প্রজেক্ট-এর সাথে যুক্ত
হয়ে এর পরিচালক হিসেবে একদল সহকর্মী নিয়ে কাজ করে আসছেন। সারা বিশ্বে এধরণের কাজ
আগে হয়নি, বলা চলে। এটাই এ ধরণের প্রথম পদক্ষেপ। অতপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও
পৃথিবীর প্রখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুদের মানস, মস্তিস্ক ও শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি
প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা প্রকল্প ও বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। ২০০৪ সাল
পর্যন্ত গবেষণা করে হাওয়ার্ড গার্নার ‘চ্যোন্জিং মাইন্ডস: দ্যা আর্ট এন্ড সায়েন্স
অব চ্যান্জিং আওয়ার অন আদার পিপল্স মাইন্ড’ শিরেনামে ধারাবহিকভাবে প্রবন্ধ-নিবন্ধ
লেখা আরম্ভ করেন।এসব গবেষণা প্রবন্ধে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, প্রত্যেক মানব
শিশুরই ৮ ধরণের বুদ্ধিমত্তা থাকে। কারও কোনটা বেশি মাত্রায় থাকে, আবার কারও মধ্যে
কোনটা কম থাকে। কিন্তু ৮টি বুদ্ধিমত্তাকে সামনে রখে শিশুদের পাঠদান ও মূল্যায়ন করা
হলে শিশুদের মান সম্মত করে তোলা যায় এবং ৮টি বুদ্ধিমত্তাই শিশুদের মধ্যে প্রবলভাবে
প্রকাশ পায়। পরে, এসব শিশু পড়াশোনা শেষে যার যার কর্মজীবনে সফল হয়। কেউ হয় ভাষা
বিজ্ঞানী, কেহ বা গণিত শাস্ত্রে দক্ষ. কেহ বা হয় চিত্রকর, কেহ সংগীত শিল্পী, কেহ
প্রাণি বিজ্ঞানী, কেহ ব্যবসায়ী, সমাজ বিজ্ঞানী, কেহ নিবীড গবেষক, চিকিৎসক,
প্রকৌশলী, প্রকৃতি বিজ্ঞানী প্রভৃতি। তাঁর উদ্ভাবিত ৮ টি বুদ্ধিমত্তা সংক্ষেপে
নিন্মে আলোচনা করা হলো;
১.মৌখিক ও ভাষাবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা: এ
বুদ্ধিমত্তায় প্রবল শিশুরা ভালভাবে তার ভাব প্রকাশ করতে পারে। সমার্থক শব্দ, রূপক
শব্দ, গল্প বলা, বাক্য বিধি, ভাষা কাঠামো, ভাষা বিজ্ঞান প্রভৃতিতে চমৎকার দক্ষ হয়।
২.গাণিতিক ও যৌক্তিক বুদ্ধিমত্তা: কিছু
শিশু আছে গানিতিক সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে পারে। সংখ্যা চেনা, গণনা করা, স্মরণ
রাখা, গানিতিক যুক্তি প্রদান ও এবিষয়ক সমস্যা সমাধান ইত্যাদি ভালভাবে পারে।
৩.শারীরিক বুদ্ধিমত্তা: কিছু শিশুর শরীর
নিয়ে ভাল ও সৃজনশীল কসরত করতে এবং প্রদর্শন করতে দক্ষ হয়। নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গি,
নিয়ন্ত্রণ, খেলা-শুলা, ক্রীড়া, শারীরিক কসরত, অভিনয়, মুখাভিনয় প্রভৃতিতে খুবই ভাল
হয়।
৪.প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা: কিছু শিশু
প্রাকৃতিক বিষয়াদির নানা বাস্তব-অর্ধবাস্তব জিনিষ দেখে ভালভাবে শিখতে পারে। এধরণের
শিশুদের প্রাকৃতিক দৃশ্য, প্রকৃতি, গাছ-পালা, গাছ-পালার শ্রেণিকরণ, ফলজ-বনজ
গাছপালা ইত্যাদির উদাহারণ বা প্রদর্শন করিয়ে শেখালে ভালভাবে শিখতে পারে।
৫. আন্ত:ব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা: কোন কোন শিশু
এমন যে, তারা একাকী চিন্তা বা একাকী কাজ করে শিখনে ভাল করে না। কিন্তু দলে কাজ
করতে দিলে ভালভাবে শিখন ফল আয়ত্ত করতে পারে।
৬. অন্ত:ব্যাক্তিক বুদ্ধিমত্তা: শিশুদের
মাঝে এমন কিছু শিশু আছে, যারা শ্রেণিকক্ষে অন্য শিশুদের সাথে বা দল করে দিলে তেমন
শিখন অর্জন করতে পারে না, কিন্তু তাকে আলাদা করে শিখতে দিলে বা একাকী শেখার সুযোগ
পেলে সে ভাল পারদর্শিতা দেখাতে পারে।
৭. সংগীতমূলক
বুদ্ধিমত্তা: কোন কোন শিশু আছে, যারা সংগীত প্রিয় হয়। পড়ার সময় গান-বাজনা শুনতে
পছ্ন্দ করে। বাদ্য যন্ত্রের শব্দ, গান শোনা, সুর শোনা বা এ জাতীয় জিনিষের মাঝেই
তার শিখণ ভাল হয়।
৮. দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তা:
কিছু শিশু আছে, তাকে বিভিন্ন রকম ছবি, দৃশ্য, মডেল, ভিডিও চিত্র ইত্যাদি প্রদর্শন
করালে তার শিখণ ভাল হয়।
প্রফেসর হাওয়ার্ড
গার্নারের ৮টি বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক শিশু শেখণ-শেখানোর এ তত্ত্বটি প্রকাশিত হওয়ার
পর শিক্ষাবিদ, শিক্ষক এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ সাড়া পড়ে যায়। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও সারা পৃথিবীতে এটি একটি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় মডেল হয়ে পড়ে।
ইউনিসেফসহ আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থাগুলো এ মডেলটি সারা বিশ্বের পশ্চাৎপদ
দেশ-এলাকাগুলোতে তা তুলে ধরে ও বাস্তবায়নে করতে শুরু করে। তাঁর বুদ্ধিমত্তা
ভিত্তিক শিখণ তত্ত্বের মূল কথা হলো; শিক্ষক পাঠদানের সময় যদি ৮ টি বুদ্ধিমত্তা বা
৮ ধরণের শিশুর কথা বিবেচনায় রেখে পাঠ দান করেন বা শিখণ-শখানো কাজ পরিচালনা করেন,
তবে সকল শিশুর শিখণ ভালভাবে হয়। আর এ ৮ টি বুদ্ধিমত্তাকে সামনে রেখে প্রশ্নমালা
তৈরি করে মূল্যায়ন করা হলে বা পরীক্ষা গ্রহন করা হলে শিশুরা হয়ে ওঠে মানসম্মত এবং
যোগ্য। আর কর্মজীবনেও শিশুর শিখণ কাজে আসে এবং তারা সফল হয়।
হাওয়ার্ড গার্নারের শিখন তত্ত্ব ও সমালোচনা: প্রফেসর হাওয়ার্ড গার্নারের উপরোক্ত ৮ বুদ্ধিমত্তা
ভিত্তিক শিখন তত্ত্বটি পকাশ হওয়ার পর একদল শিক্ষাবিদ ভিন্ন মত পোষণ করেন এবং তাঁরা
নানাভাবে তাঁর সমালোচনা করেন। কেউ বলেন, এসব অপ্রয়োজনীয় এবং শিশুরা সহজাত
বুদ্ধিমত্তায় তা অর্জন করে নিতে পারে। আবার কেহ বলেন যে, এসব কাল্পনিক কথা-বার্তা।
আসলে তাঁর কথাগুলোতে প্রামাণ্য কিছু নেই।কেহ কেহ আবার ৮ টি বুদ্ধিমত্তার সাথে আরও
৩ টি যুক্ত করেন। আর সেগুলো হলো; ১. ন্যাচারালিস্ট বুদ্ধিমত্তা, ২, স্পিরিচুয়াল
বুদ্ধিমত্তা ও ৩. এক্সিস্টেনসিয়ালিস্ট বুদ্ধিমত্তা।
হাওয়ার্ড
গার্নার ও বাংলাদেশ: বাংলাদেশে
ইউনিসেফ হাওয়ার্ড গার্ণারের ৮ বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক শিখণ তত্ত্বটি চালু করার জন্য
২০০০ সালের দিকে উদ্যোগ নেয়। নিবীড জেলা পদ্ধতির মাধ্যমে সবার জন্য শিক্ষা বা
‘আডিয়াল প্রজেক্ট’ শিরোনামে ইউনিসেফ, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে থাকে। আইডিয়াল
শব্দটির পূর্ণাংগ রূপ হলো; আই-তে ইন্টেনসিভ, ডি-তে ডিস্ট্রিক্ট, ই-তে এডুকেশন,
এল-এ ফর অল। ইন্টেনসিভ ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন ফর অল, অর্থাৎ নিবীড জেলা পদ্ধতির
মাধ্যমে সবার জন্য শিক্ষা।এ প্রক্ল্পটি আমাদের কক্সবাজার জেলায়ও বাস্তবায়ন করা হয়।
উপসংহার: উপরে আমরা, প্রখ্যাত মার্কিন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা
মনোবিজ্ঞানী প্রফসর হাওয়ার্ড গার্ণারের ৮ বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক শিখন ত্ত্ত্ব এবং এর
প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছি। ইতোপূর্বে আমি বেন্জামিন ব্লুম এবং ইবনে সিনার প্রাথমিক
শিক্ষা ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করি। যাহোক, এসব শিক্ষাবিদের ভাবনাগুলো, আমরা যারা
বিভিন্ন শিক্ষাস্তরে কাজ করছি, তাদের সবার জানা উচিত। আর নিজেদের ভাবনার সাথে
সমন্বয় করে আমরা কাজ করলে বা শিশুদের উপযুক্ত কারা জন্য শিখন-শেখানোসহ যাবতীয় কাজে
তাঁদের ভাবনাগুলো পাথেয় হিসেবে নিলে বেশ উপকৃত হবো, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন