প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিকল্পনা ও
সফল বিদ্যালয়
মোহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
সহকারি
উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী,
কক্সবাজার।
পরিকল্পনা একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক কাজে বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় একটি পরিকল্পনা থাকা
আবশ্যক। পরিকল্পনা ছাড়া চললে গন্তব্যে পৌঁছা অসম্ভব প্রায়। পরিকল্পনা করে চলার
বিষয়টি রাশিয়ার ভাবনা বলে জনা যায়।বিশেষত রাষ্ট্র পরিচালনায় পাঁচশালা পরিকল্পনা বা
দীর্ঘ মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার কথা আমরা শুনে থাকি। স্বাধীনতার পরে বরেণ্য
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে ও
তত্ত্বাবধানে আমাদের দেশের জন্য প্রণীত ও
বঙ্গবন্ধু সরকার গৃহীত পরিকল্পনা দলিলসমূহ আমার পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
আমার মনে হয়, এগুলো আমাদের বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য আকর গ্রন্থ এবং সঠিক পথের
দিশা হতে পারত। কিন্তু দেশের শাসন ব্যবস্থার টালমাটাল পরিবর্তন বা উথ্থান-পতন তা
হতে দেয়নি। যাহোক, আমি এখানে বিদ্যালয় পরিক্ল্পনার কথা ভাবছিলাম। প্রত্যেক
বিদ্যালয় যদি বছরের প্রারম্ভে একটি ভাল কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করে এবং দীর্ঘ মেয়াদী
একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করে তবে বিদ্যালয়ের সাফল্যের পালক প্রতি বছর
যোগ হতে হতে বিদ্যালয়টি সফল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়িয়ে যাবে। আর পিছনে
থাকাতে হবে না। সারাদেশে বিদ্যালয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বা স্লিপ নামে যে কার্যক্রম
পরিচালনা করা হচ্ছে তা একটি বাস্তবধর্মী প্রসংশনীয় উদ্যোগ। কিছুটা অপচয় বা অনিয়ম
যা হচ্ছে তা রোধ করে যদি প্রাপ্ত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়, তবে প্রত্যেকটি
বিদ্যালয় সফল বিদ্যালয়ে পরিণত হতে পারবে।
আমি অবশ্য এ নিবন্ধে দীর্ঘমেয়াদী (১০/১৫ মেয়াদী)পরিকল্পনার উপর গুরুত্ব
দেব, বেশি। আমরা যারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি তাঁদের বোধহয় ভেবে দেখার সময়
এসেছে যে, কেন কিছু বিদ্যালয় বার বার ভাল করে থাকে, বেশিরভাগ বিদ্যালয় নয় কেন?
প্রত্যেক উপজেলায় অন্তত ৫০টি হতে ১০০টি বিদ্যালয়ে পযার্প্ত শিক্ষক, আসবাবপত্র,
অবকাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা যদি
একটু শ্রম দিয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাই তবে নিজ নিজ বিদ্যালয়কে বিখ্যাত করে তুলতে
পারি। এ নিবন্ধে আমরা কীভাবে বিদ্যালয় পরিকল্পনা করতে হয় এবং তা বাস্তবায়নের
মাধ্যমে কীভাবে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস চালাব।
প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিকল্পনা কী?
বিদ্যালয় পরিকল্পনা
বলতে বিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রণীত একটি লিখিত-অলিখিত দলিল।এতে
বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এলাকার সকল শিশুর
জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে একটি নির্দষ্ট মেয়াদে
অজির্তব্য লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মপন্থা সন্নিবেশিত থাকবে।বিদ্যালয় ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় এমন সব সুনির্দষ্ট লক্ষ্য
অর্জনের প্রয়ান থাকবে যা সকর শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করে।
যেমন সকল শিশুর ভর্তি, নিয়মিত উপস্থিতি, লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা (ঝরে পড়া)
রোধ, ভতির্কৃত সকল শিশুর ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পন্ন করা নিশ্চিতকরণ, প্রতিটি শ্রেণির জন্য
নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন, শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি, পাঠদানের মানোন্নয়ন,
শিক্ষার্থী ভিত্তিক পাঠদান, পাঠভিত্তিক উপকরণ তৈরি ও ব্যবহার ইত্যাদি।
বিদ্যালয় পরিকল্পনার
উদ্দেশ্য:
বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন
পরিকল্পনার মূখ্য উদ্দেশ্য হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে
বিদ্যালয় পর্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদানের
মাধ্যমে বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের
সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরির সুনির্দষ্ট
উদ্দেশ্যগুলো নিন্মরূপ:
ক. বিদ্যালয় পর্যায়ে
পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ বিকেন্দ্রীকরণ।
খ. বিদ্যালয় এলাকার
চাহিদার ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরিকরণ।
গ. প্রাথমিক
বিদ্যালয়গুলোতে সামগ্রিক শিখন-শেখানোর পরিবেশের উন্নতি সাধন ও শিক্ষার গুণগত মান
বৃদ্ধিকরণ।
ঘ. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
ভর্তির জন্য শিশুদেরকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রস্তুতকরণ।
ঙ. প্রাথমিক শিক্ষায়
সমতা সৃস্টি ও বিদ্যমান বৈষম্য হ্রাসকরণ।
চ. বিদ্যালয়কে
শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।
ছ. শিক্ষক/শিক্ষিকাদের
শিখন-শেখানো পদ্ধতির মান উন্নয়ন, স্থানীয় জনগণসহ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে
তাঁদের সম্পর্ক উন্নয়ন সাধন ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি মালিকানা বোধ
সৃস্টিতে উৎসাহ প্রদান।
জ. শিক্ষক/শিক্ষিকা,
শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং স্থানীয় জনগণকে বিদ্যালয়ের কর্মকান্ডের সঙ্গে
সম্পৃক্তকরণ।
ঝ. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
উন্নয়ন কর্মকান্ডে স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকে উজ্জীবিত করে শিক্ষাকে
দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দীপক হিসেবে প্রতিষ্ঠিতকরণ।
ঞ. বিদ্যোলয়ে প্রকৃত
ভর্তির হার ১০০%-এ উন্নীতকরণ।
বিদ্যালয় ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরির প্রক্রিয়া:
বিদ্যালয় উন্নয়ন
পরিকল্পনা কমিটির সদস্যবৃন্দ, প্রধান শিক্ষক এবং সহকারি শিক্ষকদের সহায়তায় পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য একটি দিবস
নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট সকলকে আমন্ত্রণ জানাবেন। সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের
দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করে
পরিকল্পনা সভাটির প্রস্ততি নিবেন প্রধান শিক্ষক।নির্ধারিত তারিখে পরিকল্পনা সভার
আয়োজন করা হবে। সভায় স্লিপ কমিটি, পিটিএ, সামাজিক তদারকি কমিটি, জনপ্রতিনিধি,
অভিভাবক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। সভায বিদ্যালয়ের
বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিদ্যালয়কে অংশগ্রহণকারিগণ কীভাবে দেখতে চান এবং
তাদের চাহিদাগুলো কী কী তা নিরূপণ করে করণীয়সমূহ চিহ্নিত করে নিতে হবে। এতে
বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যাবতীয় বিষয়, যথা- বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, সম্পদ, জমি-জমা,
নেতৃত্ব ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, শিখন-শেখানো কার্যক্রম, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিখন
পরিবেশ, আনন্দদায়ক পরিবেশ, শিশুবান্ধব পরিবেশ, শিক্ষা উপকরণ, খেলনা সামগ্রী,
আসবাবপত্র, খেলার মাঠসহ সব কিছু এ পরিকল্পনা সভায় আলোচনা করা হবে। সাবির্ক সমস্যা,
সুবিধা, ঝুঁকি এবং শক্তিশালী বা কৃতিত্বপূর্ণ দিকগুলো ব্যাপক বিশ্লেষণ করে একটি উত্তম পরিকল্পনা তৈরি করা হবে।
পরিকল্পনাটি হবে এক বছরের জন্য, কিন্তু লক্ষ্য হবে আগামী ১০/১৫ বছরের মধ্যে
বিদ্যালয়টিকে একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। গৃহীত পরিকল্পনাটি
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের নিকট হতে অনুমোদন গ্রহন করার পর তা ধীরে ধীরে
বাস্তবানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
তদারকি কর্তৃপক্ষ: বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি (এসএমসি), স্লিপ কমিটি ও সামাজিক
তদারকি কমিটি সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন করবেন।এক্ষেত্রে
প্রধান শিক্ষকই মুখ্য দায়িত্ব পালন করবেন। আর এক একজন প্রধান শিক্ষক যেহেতু একটি
বিদ্যালয়ে অনেকদিন ধরে কর্মরত থাকেন, তিনি চাইলে যা ইচ্ছা করতে পারেন। তিনি চাইলে
একটি বিদ্যালয়কে সঠিকবাবে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারেন। আবার তিনিই তাঁর বিদ্যালয়কে
একই বৃত্তে রেখে দিতে পারেন। কিন্তু জাতি ও সরকারের প্রত্যাশা হলো; প্রত্যেকটি
বিদ্যালয় হবে গাইবান্ধ্যা জেলার শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা বগুড়া জেলার
মোকামতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মত হবে।
আথির্ক সংস্থান: সরকার বিদ্যালয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রতি বছর
২০,০০০/- টাকা হতে ৫০,০০০/- টাকা পর্যন্ত একটি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।সরকারিভাবে
প্রদত্ত এবং স্থানীয় উৎস হতে সংগৃহীত অর্থ সমন্বয়ে পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত
সিদ্ধানসমূহ বাস্তবায়ন করা হবে।
অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সমূহ: বিদ্যালয় পরিকল্পনায় শিখন-শেখানো
সামগ্রী কেনা, শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ, শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃস্টি, খেলনা সামগ্রী
ক্রয়সহ এধরণের অন্যান্য জিনিষ ও বিষয়গুলো প্রাধান্য দেয়া হবে।
বিদ্যালয় পরিকল্পনা ও বিদ্যালয় উন্নয়ন পরিকল্পনা (স্লিপ): স্লিপ পরিকল্পনা হবে বিদ্যালয়ের একটি
স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা। কিন্তু আমি গুরুত্ব দেব একটি স্থায়ী বিদ্যালয় পরিকল্পনার
ওপর। এধরণের পরিকল্পনা প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা হবে একজন
দূরদর্শী নেতা ও ব্যবস্থাপকের মত। তিনি অন্যত্র চলে গেলেও তাঁর অবদান কথা বলবে,এমন
একটি বিদ্যালয় পরিকল্পনাই আমার নিকট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। শিবরামের
প্রধান শিক্ষক চ্ছেন, এমন একজন প্রধান শিক্ষক্ সবাই তাঁর মত হবেন এমনটা নয়, তাঁর
পথ অনুসরণ করে দেখতে পারেন। তবে অনেক কিছু হয়ে যাবে।প্রত্যেক বিদ্যালয়ে এবং
ইউআরসিগুলোতে দেমশর ভাল ভাল বিদ্যালয়গুলো ও প্রধান শিক্ষকের পরিচিতি সম্বলিত
কয়েকটি পুস্তিকা দেয়া হয়েছে। এসব পুস্তিকা আপনাদের বিদ্যালয়ে আছে নিশ্চয়ই সেগুলো
পড়ে দেখুন। সেখান হতে আপনার বিদ্যালয়ের জন্য একটি রূপরেখা পেয়ে যাবেন।আর সেভাবে
একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগুতে চেষ্টা করুন। সফল হবেন অবশ্যই।
উপসংহার্: উপরে আমরা
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করার কথা লিখেছি। আসলে একটি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সফল প্রতিস্ঠানে পরিনত করা কঠিন কাজ। বিশেষত দেশের
সব এলাকার মানুষ এখনও শিক্ষা সচেতন য়ে ওঠেন নি।ফলে ্রধান শিক্ষক এবং সকারি
শিক্ষকগণ যতই আন্তরিক হন না কেন আমাদের প্রত্যাশা পুরনে তাঁরা পুরোপুরি সফল হতে
পারছেন না।যাহোক, আমরা যে যেখানে বা যে
পদেই থাকি না কেন সবাই যার যার মত পরিকল্পনা করে আগানোর টেষ্টা করলে হয়ত একদিন
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সফল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন