শিক্ষার্থীদের অনানুষ্ঠানিক মূল্যায়নের কৌশল
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
শিক্ষার্থীরা অর্জনযোগ্য যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে কিনা, তা যাছাই
করাই হলো, মূল্যায়ন। আর মূল্যায়নই হোক বা পরীক্ষা, শিক্ষার্থীদের মাঝে সদা ভীতি ও
উত্তেজনা কাজ করে। শিক্ষার্থীদের এ ভীতি হতে মুক্তি দেয়ার কোন উপায় আছে কী? হয়তো
নেই, কিন্তু বিকল্প আছে, অবশ্যই।উন্নত বিশ্বে এ জন্য নানা ধরণের কৌশল অবলম্বন করা
হয়ে থাকে। অভিভাবক, শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ; সবাই শিক্ষার্থীদের একটি শিক্ষাস্তর সমাপনান্তে
সেসব যোগ্যতা তাদের অর্জিত হোক, পড়াশোনায় ভালভাবে পারদর্শী হোক, তা কামনা করেন।আর
তা না হলে সবাই হতাশ হন, চিন্তিত হয়ে পড়েন।এ পরিস্থিতিতে নানা কৌশল অবলম্বন করা
হয়ে থাকে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন শিক্ষাবিদ জেফ কিনী বর্ণিত পরিস্থিতি মোকাবেলা
করার জন্য অথবা বিকল্প পন্থা অবলম্বন করার জন্য নিন্মোক্ত ৫টি কৌশলের কথা বলেছেন।
এগুলো অনুসরণ করলে হয়তো বিকল্প কৌশলে শিক্ষার্থীদের কাংখিত যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জনের
মান যাচাই করা যেতে পারে।
.
রিডিং বা পঠন-পাঠন: প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের শিক্ষা চক্র
সমাপনান্তে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পড়তে সক্ষম হওয়া উচিত। প্রত্যেক শিক্ষাথীর উচিত
হবে, আনন্দ পাওয়া ও তথ্য পাওয়ার জন্য নিয়মিত পড়তে থাকা।তারা বই নিয়ে নাড়াচড়া করতে
থাকবে এবং অন্যান্য লিখিত জিনিষ পড়তে থাকবে। আর পড়তে পারা বলতে কী বুঝায়?এর অর্থ
হলো, কোন রচনা বা বই পড়া ও ভালভাবে বুঝা, যাতে পড়া তথ্য ব্যবহারিক কাজে প্রয়োগ
করতে অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্য ব্যক্তিদের সাথে কথা বলতে পারা। শিক্ষার্থীরা যখন
কোন পড়া পড়তে ও সে অনুযায়ি কাজ করতে পারে, তখন তাদের ভাষা এবং ভাবনা হয় ভিন্ন
ধরণের। এ ক্ষেত্রে তাদের পড়তে পারার দক্ষতা মূল্যায়নের একটি উপায় হলো, তাদের ভাল
শিখন ও ভাবনাগুলো নিবীডভাবে পর্যযবেক্ষণ করা।উদাহারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে
যে, তাদের প্রতিদিনের বক্তব্য রেকর্ডকরণ, অভিজ্ঞ শিক্ষকগণ বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক
যোগ্যতা পরিমাপ করার জন্য দু‘টি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। একটি হলো,
শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত বাক্যে ব্যাকারণগত সমস্যা পরীক্ষা করা এবং অন্যটি হলো,
তাদের শব্দভান্ডার যাচাই করে দেখা। একইভাবে তাদের লেখা বিষয় বা উত্তরপত্র যাচাই
করে দেখা যেতে পারে। নির্দিষ্ট কোন পঠন সামগ্রী বা প্রবন্ধ অথবা বই না নিয়ে নমুনা
হিসেবে যে কোনটা নেয়া যেতে পারে।
.
ইন্কুয়ারি বা অনুসন্ধান: শিক্ষার্থীরা সহজাতভাবে
অনুসন্ধিৎসু হয়ে থাকে। কিন্তু বিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের
অনুসন্ধিৎসাকে জাগ্রত করা এবং বিকশিত করার জন্য তেমন কিছু তারা করতে পারে না।
বস্তুত: শিক্ষার্থীরা যখন বিদ্যালয় গমন করে তারা খুব বেশি প্রশ্ন করার সুযোগ পায়
না, কোন কিছু অনুসন্ধান সুযোগ কম থাকে ও অনুসন্ধানের তীব্রতা কম হয় এবং কৌতূহল কমে
যায়।শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি অন্যতম মর্মপীড়াদায়ক বিষয় হলো, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
নতুন শিখন ও বৈজ্ঞানিক আবিস্কার এবং উদ্ভাবিত বিষয়গুলোকে অবহেলা করা। শুভ সংবাদ হচ্ছে,
গবেষকগণ কোন কিছু খুঁজে বের করতে শিশুদের কৌতূহল মেটাতে এবং সরাসরি নিজস্ব ক্ষমতা
ব্যবহার করার মাধ্যমে শিখনকে মূল্যায়ন করার উপায় বের করেছেন। শিক্ষার্থীদের
অনুসন্ধারন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে কয়েকটি পদ্থতি অবলম্বন করা যেতে পারে। একটি
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো লিখে রাখা যেতে পারে।
তাদের প্রশ্নগুলো গুরুত্ব অনুযায়ি সাজিয়ে নেয়া যায়। যেমন- সে প্রশ্নগুলোর তথ্য
ব্যবহার করে উত্তর দেয়া যায় কী? শিক্ষার্থীরা কী প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া প্রয়োজন
মনে করে? তারা কী প্রশ্ন করার সময় কৌশলী হয়?
.
ফেলেক্সিবল থিংকিং এন্ড ইউজ অব
এভিডেন্স বা নমনীয় ভাবনা এবং প্রামাণ্য দলিল ব্যবহার: বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কোন
জিনিষ বা পরিস্থিতি সম্পর্ককে বিভিন্ন বিকল্প উপায়ে ভাববার ক্ষমতা অর্জন করা একটি
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন পদ্ধতি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শিক্ষার্থীদেরকে তাদের পরিণতি বা জানা বিষয়ে কোন
রচনা লেখা বা এ জাতীয় কাজ করতে দিলে, তারা অন্য বিষয়গুলোতেও পারদর্শী হয়ে ওঠে।
তাদেরকে শুধু তথ্য দিয়ে কৌশল ও যুক্তিগুলোকে শিখিয়ে দিলে তা তারা করতে সক্ষম হয়ে
ওঠে। ক্রমান্বয়ে জটিল বা নতুন নতুন বিষয়েও তারা যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
.
কনভার্সেশন বা কথোপকথন: শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললে বা
কথোপকথনে লিপ্ত হলে, অনেকগুলো শিখনফল বা শিখন যোগ্যতা অর্জিত হয়। কিন্তু তাদের
নিজেদের মধ্যকার কথোপকথনও গুরুত্বপূর্ণ। আর, তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা
কঠিন কিছু নয়। গবেষকরা অনেকদিন ধরে কথোপকথন বিশ্লেষণ এবং কথোপকথনের দক্ষতাগুলো
বিকাশ সাধন করে আসছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, কথোপকথন চলাকালে
কতগুলো বাক্য উচ্চারিত হয়েছে, কত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, কত সময় ও লেগেছে; এসব
পরীক্ষা করেই শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা মূল্যায়ন করা যায়। তাদের পর্যযবেক্ষণ করা
যায়, প্রত্যেকে কথা বলতে কত সময় নেয়; এসব কথায় কত বার পালা পরিবর্ততন হয়েছে, কী কী
বিষয়ে কথা হয়েছে, এসব কতটা গভীরতর ছিল, যা বলেছে তার মাত্রা কী রকম; প্রভৃতি।
তাছাড়া, শিক্ষার্থীদের কথোপকথনে তথ্য ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি, মতৈক্য বা ভিন্নমত;
এসব দিক বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। এরকম কথোপকথন পদ্ধতিতে শিক্ষকের ভূমিকাও
বিবেচনায় নেয়া উত্ত। অনেক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কথোপকথন দক্ষতা উন্নয়নে বয়স্করা
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গবেষকরা মা-বাবা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যকার
কথোপকথন রেকর্ড করে দেখতে পারেন যে, অনেক অভিভাবক প্রায়ই তাদের শিশুদের সাথে কথা
বলেন, উত্তর দেন ও প্রশ্নগুলো করেন। আর শিশুদের প্রশ্নের উত্তর দান পদ্ধতিকে
সংশোধন এবং উন্নত করতে সহায়তা করেন। বাবা-মারা শিশুদের কথা বলার সময় ব্যবহৃত তথ্য
বৈশ্বিক ধারণা অর্জনে প্রয়োগ করতে এবং কথোপকথন প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধকরণে কাজে লাগান।
যাহোক, সব পরিবার এতে একই ভূমিকা পালন করতে পারে না।আর দরিদ্র ও অসচেতন মা-বাবারা
এক্ষেত্রে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম নন। বিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ, শিক্ষার্থীদের
কথোপকথনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কার্যকর অবদান রাখেতে রাখতে পারেন বেশি। শিক্ষক ও
শিক্ষার্থীরা একই স্থানীয় ভাষায় কথা বললে, ভাষাগত দক্ষতা বা বর্ণনামূলক ভাষাগত
যোগ্যতা অর্জনে তেমন সহায়ক হয় না। শিক্ষকদের নিবীড প্রশিক্ষক থাকলেই, শিশুদের
কথোপকথন দক্ষতা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দান, সমৃদ্ধকরণ এবং তাদের জ্ঞানকে গভীরতর করতে
পারেন। শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা, পঠন-পাঠন কৌশল, মূল্যায়ন ও শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক
প্রশিক্ষণ গ্রহন করে শিক্ষকগণ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠতে পারেন। আর শিক্ষক যদি কথোপকথন কৌশল
প্রয়োগে দক্ষ হন, তবে শিক্ষার্থীদের মাঝে এ কৌশল প্রয়োগ করে তাদেরকে মূল্যায়ন করতে
পারেন।
.
কোলাবোরেটিভ বা সহযোগিতামূলক ভূমিকা
পালন: সহযোগিতামূলক
পদ্ধতির ধারণাটি পাশ্চাত্যে বেশি বেশি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এ
পদ্ধতিটি সব সময় প্রয়োগ হয়ে আসছে।তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক, সবাই এটি প্রয়োগ
করলে অত্যন্ত কার্যযকর হবে। শ্রেণিতে বিভিন্ন পেশার মানুষের শিশু বা শিক্ষার্থী
থাকে। এত থাকে সবল-দুর্বলসহ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। কিন্তু শিক্ষাদানের সময়
শিক্ষক-শিক্ষার্থী; হোক না শিক্ষার্থী যে কোন মেধা বা স্বাস্থ্যের অধিকারি
সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকলে, শিখন; সফল ও সার্থক হবে।শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা
করবে। সেটা পাঠ গ্রহনে হোক বা শিখন-শেখানোর যে কোন কাজ হোক। অথবা জটিল-কঠিন-সহজ
সকল ধরণের শিখন-শেখানোতে এবং সব সময় পরস্পরকে সাহায্য করবে। সবল শিক্ষার্থী; দুর্বলদের
শিখনে সাহায্য করবে। সুস্থ-সবল শিশু অসুস্থ-দুর্বল শিশুদের সহায়তা দেবে। বিশেষ
চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা, পড়াশোনা ও খেলাধুলাসহ সকল প্রকার কার্যক্রমে অন্যদের
সহযোগিতা পাবে, সহানুভূতি পাবে।এভাবে বিদ্যালয়ে একটি কোলাবোরেটিভ বা সহযোগিতামূলক
পরিবেশে শিখন-শেখানো কার্যযক্রম চলতে থাকলে আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন না করেও, শিক্ষার্থীদের
কাংখিত যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে দক্ষ করে গেড়ে তোলা যায়।
.
এন্গেজমেন্ট বা শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত
রাখা: শিক্ষার্থীরা
যা শিখছে, তা তারা নিয়মিত ধারণ করতে পারছে কিনা, তা স্বাভাবিক প্রক্রিযায় মূল্যায়ন
করা প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণণ হলো, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কৌশলে
যা শিখছে তা শেখার সময় তাদেরকে প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে কিনা; এটাও
দেখতে হবে যে, শিখন-শেখানো চলাকালে প্রাপ্ত সহযোগিতাসমূহ তারা কাজে লাগিয়েছে কিনা;
তা দেখা।বিদ্যালয়ে এক সাথে ২০ মিনিট কোন বিষয়ে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ সহকারে শিখলে,
তারা সফল হয়; এমন একটি মতামত দিয়েছেন, একজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী হেরী ব্রিগ হাউজ।
আবার, কোন কোন শিক্ষার্থী দীর্ঘ সময় বা অনেক্ষণ শিখলেও, কোন কোন বিষয় ভালভাবে
শিখতে সক্ষম হয় না। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীং উপকৃত হচ্ছে কিনা।
তবে শিক্ষার্থীদের স্বভাব হলো, তারা কোন কোন বিষয়ে বেশি মনোনিবেশ করে, আর কোনটাতে
তেমনটা করে না। আসল কথা হলো, তাদেরকে শিখন-শেখানো কাজে নিয়োজিত রাখা। তারা যদি
যত্ন সহকারে শিখে; তবে, তাতেই অনেক কাজ দেয় এবং আনুষ্ঠানিক মূল্যায়নের অবকাশ তেমন
থাকে না। নিয়োজিত থাকা বা শিখনে ব্যস্ত রাখতে পারলেই, তাদের কাংখিত যোগ্যতা-দক্ষতা
অর্জিত হয়ে যায়।
.
ওয়েল বেয়িং বা কল্যান সাধন করা: শিক্ষার্থীদের জন্য সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
হলো, বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন সময়ে শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে কাজে লাগানো। তাদেরকে
মাঝে মাঝে প্রশ্ন করা যেতে পারে, তাদের শিখন কেমন হচ্ছে, তাদের কেমন লাগছে;
প্রভৃতি। তাদের শিখনকে তারা উপভোগ করতে পারছে কিনা? তারা যা করছে, তাতে তাদের
উপকার হচ্ছে কিনা? এমন সব প্রশ্ন-উত্তরেই তাদের এক ধরণের যাচাই করা হয়ে যায়।
শিক্ষকগণ এমন সব পদ্ধতি হয়তো কম ভাবেন, কিন্তু একটু যত্নসহকারে এসব কৌশল অবলম্বন
করলেই তাদের শিখন মাত্রার পরিমাপ হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীদেরকে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা না নিয়ে বা মূল্যায়ন না
করেও যে, তাদের যোগ্যতা, শিখন ফল বা কাংখিত দক্ষতা অর্জিত হয়েছে কিনা, তা যাচাই
করতে উপরোক্ত কৌশলগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে। এসব কৌশলের প্রয়োগ, হতাশা বয়ে আনে
না, বরং পরিতৃপ্তি দেয়; অভিবাবক, শিক্ষক এবং কর্তৃপক্ষকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন