উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রাথমিক শিক্ষা
নিয়ে ভাবতে হবে নতুন কিছু
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
উন্নয়নশীল বা দরিদ্র্য দেশগুলোর প্রাথমিক শিক্ষা কেমন হওয়া
উচিত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে আমরা কতটা
লাভবান হতে পারি? আমাদের দেশের শিশুরা সেসব দেশের শিক্ষাক্রমের আলোকে পড়াশোনা করে
কতটা উপকৃত হবে? যাহোক, আজকের নিবন্ধে তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক স্তরের
শিখন-শেখানো কার্যযক্রম কেমন হওয়া উচিত; সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
উন্নয়নশীল বিশ্ব ও
প্রাথমিক শিক্ষা:
অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের গন্ডি পার হতে
পারেনা।দৃষ্টান্ত হিসেবে ঘানার কথা উল্লেখ করা যায়।সেদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
ভর্তি হওয়া মোট শিশুর ৫০ ভাগ শিশুই প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপন করতে পারে না।যারা
সমাপন করে তাদের অর্ধেকেরও কম শিশু একটি সাধারণ অনুচ্ছেদ, লিখিত বা মৌখিকভাবে
প্রকাশ করতে পারে না।ইউনেস্কো ঘোষিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে
সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও সার্বজনীন করা
হয়েছে। কিন্তু অনেক শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পূর্বেই বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়ে।
বিদ্যালয়ে গমনাগমনের সমস্যা ও পড়াশোনার ব্যয় নির্বাবাহসহ অনেকগুলো কারণে শিশুরা
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না ও ঝরে পড়ে। শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ অবৈতনিক হলেও,
দুপুরের খাবার. পোশাক এবং পরীক্ষার ফি‘ও বহন করতে পারে না, অভিভাবকরা। আর বিদ্যালয়ে
শিক্ষার মান খুব নিচে হওয়ায় অভিবাকদেরকে বাধ্য হয়ে গৃহ শিক্ষক বা প্রাইভেট পড়াতে
হয় বলে, অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করতে হয়। আর শিশুরা পারিবারিক কাজ না করে বিদ্যালয়ে
পড়তে গেলে অভিভাবকরা তাদের আয়-বর্ধধক কাজে লাগাতে পারে না। অবাক হওয়ার কিছু নেই
যে, বিদ্যালয়ে যেহেতু ভালভাবে পড়াশোনা হয় না অথবা সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞানও অর্জিত
হয়না, তাই অভিবাবকরা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতেও আগ্রহী হয় না। আবার, অনেক
ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরে পড়াশোনা ভাল হলেও, মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে পড়াশোনা অব্যাহত
রাখে খুব কম শিশু।উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। আর
শিশদের ৫ম শ্রেণি; এমন কি ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও, তাদের তেমন কোন উপকার
হয় না।দরিদ্র এলাকাগুলোতে বা দেশগুলোতে বিপুল জনসংখ্যার নিরাপদ কর্মসংস্থানের
ব্যবস্থা নেই এবং এমন কি সাধারণ কৃষি কাজ এবং ছোট-খাট ব্যবসায় করারও সুযোগ-সুবিধা
কম।এসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও মারাত্নক। ডাইরিয়া, ছোঁয়াছে রোগ এবং ম্যালেরিয়া
জাতীয় নিরাময়যোগ্য রোগে এখানকার লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে। এসব দেশে
পাশ্চাত্যের সনাতন পাঠ্যসূচি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবই ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে
থাকে।আর বিষয়ও অনেকটা একই।গণিত, বিজ্ঞান, ভাষা ও সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো হয় এসব
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।এসব বিষয়ে গ্রীক দর্শশন, গাণিতিক জটিল সমস্যা বা
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চস্তরের সব বিষয় থাকে।গরীব দেশের শিশুদের এসবের প্রতিফলন; তেমন
কাজে আসে না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অতি মেধাবী শিক্ষার্থীরাও সম্পদশালী দেশগুলোর
শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি প্রতিকুলতা মোকাবেলা করতে হয়।দরিদ্র্ দেশের অধিকাংশ
শিক্ষা সমাপনকারি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা বা পেশাগত কর্মসংস্থানের
সুযোগ-সুবিধা সীমিত হওয়ায়, তাদেরকে হয়ত পারিবারিক কাজ অথবা কৃষি কাজ অথবা ছোট-খাট
ব্যবসায়-বাণিজ্যমূলক কাজে নিয়োজিত হতে হয়।বিদ্যালয়ে পড়াশোনা, গরীব দেশের শিশুরা না পারছে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে, আবার
না পারছে, নিরাপদ জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ বা সম্পদ আহরণের সুযোগ। তাছাড়া,
বিদ্যালয়ের শিক্ষা; স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
দরিদ্র দেশগুলোতে জীবন-যাপন প্রত্যাশা, তেমন বেশি নয়। আর স্বাস্থ্য সচেতনতা ও
প্রাথমিক জিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা থাকলেই, এসব দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান অনেক ভাল
হয়।দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের জন্য অধিক শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে জীবন দক্ষতাগুলো
বেশি করে অর্জন করা প্রয়োজন। আর এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রমে, সংখ্যর ব্যবহারিক
ধারণা এবং ছোট ছোট ব্যবসায় ও বৃত্তিমূলক উদ্যোক্তা হওয়া দক্ষতা, স্বাস্থ্য
সচেতনতা, ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা দক্ষতামূলক বিষয়গুলো সংযোজন
করা। ৫ বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর পরিচালিত একটি বড় ধরণের
সমীক্ষায় বাংলাদেশ, ভারতসহ অনেকগুলো দেশের সরকারি ও বেসরকারিভাবে পরিচালিত শত শত
বিদ্যালয ও লক্ষ্ লক্ষ শিক্ষার্থীকে সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের শিখণ-শেখানো
কার্যযক্রম হতে জীবনযাত্রা এবং সমস্যা ও সাফল্যগুলো পর্যালোচনা করা হয়।তাছাড়া, সকল
প্রকার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, পড়াশোনার মান, পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীদের অর্জিত
দক্ষতা-যোগ্যতার আলোকে কর্মজীবনে প্রবেশসহ সব কিছু এতে বিবেচনা করা হয়।
শিক্ষার নতুন মডেল: উন্নযনশীল দেশগুলোতে বর্তমানে যে
পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম চলছে তাতে নতুনত্ব আনা অবশ্যক। সনাতন বিদ্যালয়
শিখন-শেখানো বিষয়বস্তু এবং যোগ্যতা অর্জন করার পাশাপাশি দৈনন্দিন আর্থিক কার্যক্রম
ও স্বাস্থ্য বিষয, প্রশাসনিক দক্ষতাগুলোকে বিমেস গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য।আর শিখণ
মডেলটির নাম দেয়া যেতে পারে ‘ স্কুল ফর
লাইফ’ বা জীবনের জন্য বিদ্যালয়’। শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পড়াশোনা করিয়ে তাদের
কর্মজীবনে অর্থনৈতিক ও সমাজ ব্যাখ্যামূলক এবং সমাজ এর একটি ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটে।
এ মডেল অনুযায়ি শিখণ বিষয়বস্তু এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন
করতে হবে। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে ইতোমধ্যে এ মডেল ধারণ ও প্রতিফলন
ঘটানোর প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।প্রস্তাবিত শিক্ষার নতুন মডেল বাস্তবায়রেন
প্রথম পদক্ষেপ হবে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা
সৃস্টিমূলক বিষয়কে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক
করা। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হবে, শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখণ-শেখানোকে গুরুত্ব দেয়া। শিক্ষার্থীরা
নিজেরাই দলীয়ভাবে জটিল এ মডেলটি
বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের সব সমস্যা ও প্রজেক্ট ভিত্তিক পদ্ধতি অনযুসরণ করে কাজ
করানো। সারা বিশ্বে বয়স্ক শিখন-শেখানো শিক্ষাক্রমে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হয়ে
আসছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই ও বিষয়বস্তু অর্জিত শিখণ ফল, দক্ষতা ও যোগ্যতাসমূহ
বাস্তব জীবন-যাপনের সাথে মিলিযে অনুশীলণ করবে বেশি বেশি। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ
করা যায় যে, শিক্ষাথীরা হাতধোয়াসহ স্বাস্থ্যসম্মত আচার-আচরন ও রীতনীতি অনুশীলণ
করবে।বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে ‘জীবনের জন্য বিদ্যালয়’ কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করা
হচ্ছে। এ মডেলটি বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের পরিচিতি ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে
সংশ্লিষ্ট উপকরণের ব্যবহার খুব কাজ দেবে। এতে শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান, দক্ষতা ও
দুষ্টিভঙ্গিসহ আচরণিকভাবে ব্যাপক উপকার বযে আনবে। বিদ্যালয় ত্যাগের পর তাদের আর
বিশেষ দক্ষতা অর্জনমূলক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে না।
উন্নয়নশীল বিশ্বের
শিক্ষায় নাটকীয় পরিবর্ততন ঘটছে: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের
বিষয়বস্তু মুখস্থ করে এবং পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে থাকে। এভাবে সনাতন পদ্ধতিতে
শিখণ-শেখানো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা যেন সম্পদ বিনষ্ঠ করা এবং ব্যক্তিগত ও
সামাজিকভাবে সক্ষমতা অপচয় করার নামান্তর হয়ে পড়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি ও বিভিন্ন
সংস্থা; যারা শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিদকরণ নিয়ে কাজ করছে তাদের
কর্মসূচিতে এখন থেকে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের ওপর বিশেষ জোর দেয়া
হয়েছে।আর এ সবকে শিক্ষার্থীদের বাস্তবজীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এতদিন
শিক্ষা উদ্যোগগুলোতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের মাধ্যমে উচ্চতর নব্মর পাওয়া বা গ্রেড
অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছ্। এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা করা হয়েছে। এখন জোর
দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের পারিপার্শ্বিক বা পরিবেশ এবং দেশ-বিদেশের খেলাধুলাসহ যে
কোন একটি বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠার ওপর। তবে জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে, দারিদ্র্য বিমোচন
হবে।আর ব্যক্তিক্রম মেধা বা উচ্চতর শিখন দক্ষতা অর্জন করে, এমন শিক্ষার্থীরাই শুধু
উচ্চতর পড়াশোনা করবে ও কর্মজীবন বেছে নেবে।
পরিশেষে বলতে হয়, বিশ্বব্যাপী শিক্ষ্যার
লক্ষ্য ছিল, প্রত্যেক শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা। আর উন্নত-অনুন্নত সকল দেশে এ
লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা। আর
মানসম্মত শিক্ষা বলতে শুধু পুঁথিগত বিদদ্যার্জন, পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া বা ভাল
গ্রেড পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে, কাংখিত লক্ষ্য অর্জন হবে না। সনাতন বা
ঔপনিবেশিক শিক্ষা মানস হতে বেরিয়ে এসে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে কর্মমুখি বা
বাস্তব জীবনধর্মী শিক্ষা গ্রহণকেই বেশি বেশি দৃষ্টিপাত করতে হবে। আজকের চাহিদা
হলো, ‘স্কুল ফর লাইফ’ বা জীবনের জন্য বিদ্যালয়’‘ অর্থাৎ জীবন-যাপনে কাজে লাগানো
যাবে, এমন বাস্তবধর্মী শিখণই উন্নয়নশীল বিশ্বের শিখণ মডেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন