শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫

Ibne Sina and his Primary Education Thoughts

ইবনে সিনা ও প্রাথমিক শিক্ষা
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
ইবনে সিনা বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও মুসলিম পন্ডিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে তাঁর অবদানের জন্যই তিনি বেশি আলোচিত। কিন্তু তাঁর শিক্ষা ভাবনা, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষা ভাবনাও যে, একটি বিজ্ঞান সম্মত ধারণা তা তেমন একটা আলোচনায় আসেনা।তিনি ৯৮০ সালে জন্ম গ্রহন করেন এবং ১০৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি উজবেকিস্থানের বুখারা নগরীতে আফসানা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন।পারিবারিকভাবে তিনি, বুদ্ধিবৃত্তিক বিজ্ঞান এবং দার্শনিক অনুসন্ধান চর্চার ঐতিহ্য ধারণ করেন।ইবনে সিনা আব্বাসীয় শাসনামলে চতুর্দশ শতাব্দীর মানুষ। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণ যুগ হিসেবে আখ্যায়িত এ সময়কাল। একঝাঁক মুসলিম বুদ্ধিজীবী; এসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, সাহিত্য, অনুবাদ প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চ মার্গীয় গবেষণা ও প্রকাশনা নিয়ে কাজ করেন।যেহেতু আরব অঞ্চলের ভাষা আরবী, তাই ইবনে সিনা প্রখ্যাত গণিত শাস্ত্রবিদ আল-খাওয়ারিজিমীর নিকট আরবী শেখা আরম্ভ করেন। তাঁর মাতৃভাষা যদিও ফার্সী ছিল, তিনি আরবী ভাষায় দ্রুত দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হন। অতপর তাঁর পিতা তাঁকে কুরআন ও সাহিত্য পাঠ গ্রহন করানোর দিকে দৃষ্টি দেন এবং এ দু‘টি বিষয়ে পৃথক পৃথক শিক্ষক নিযুক্ত করেন। শিশু, ইবনে সিনা ১০ বছর বয়সে পৌঁছার আগেই কুরআন শিখে ফেলেন এবং সাহিত্য জগতের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। অতপর, তিনি দর্শন, জ্যামিতি ও গণিত শিখণে মনোনিবেশ করেন। এসময় তাঁর পিতা তাঁকে পাটি গণিত, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ের তৎকালীন খ্যাতিমান পন্ডিত মাহমুদ আল-মাসাহ-এর নিকট অধ্যয়নের জন্য প্রেরণ করেন। তিনি ইসলামী আইন বা ফিকাহ শাস্ত্র এবং সুফিবাদ নিয়েও পড়াশানা করেন।এসময় আব্দুল্লাহ আল-নাতিল নামক একজন প্রখ্যাত দার্শনিক বুখারা নগরীতে আগমন করলে, ইবনে সিনার পিতা তাঁকে তাঁর নিকট অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। তাঁর কাছে ইবনে সিনা তাত্ত্বিত্ত্ক বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে অধ্যয়ন করেন। এ পর্যায়ে ইবনে সিনার মাঝে জ্ঞান অর্জনের গভীর অনুসন্ধিৎসা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আকর্ষণ বোধ লক্ষ্য করা যায়। অতপর তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে গভীর অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ইবনে সিনা তাঁর সময়ের সকল বিজ্ঞানীকে খ্যাতিতে অতিক্রম করে যান।তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করেই ক্ষান্ত হন নি, বরং শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যায়ও দক্ষ হয়ে ওঠেছিলেন। ১৬ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে দক্ষ ও পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। এ সময়কালের মধ্যে তিনি যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শন শাস্ত্রের সকল বিষয়ে বিচরণ করেছিলেন। ১৮ বছর বয়সে পৌঁছার পূর্বেই তিনি, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। ২১ বছর বয়সে ইবনে সিনা, তাঁর কিছু শিষ্যের অনুরোধে গণিত ব্যতীত অন্য সকল তাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিষয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ রচনা করেন। আর গ্রন্থটির নাম দেন, আল-মাজমু। তৎকালীন যুগে তাঁর দেশে ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার পালা বদলের খেলা। কখনও কখনও তিনি সরকারি দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন থাকলেও তিনি বিজ্ঞান বিষয়ক অধ্যয়ন এবং বিজ্ঞান শিক্ষা দান করা হতে বিরত হন নি। তিনি সদা শিষ্য পরিবেষ্ঠিত এবং গবেষণামূলক বা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।ইবনে সিনার ১০০০ বছর বয়স পূর্তি উপলক্ষে ইউনেসকো ১৯৮০ সালে শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃত হিসাবে তাঁকে মরেণোত্তর পুরস্কারে ভুষিত করেছে।
ইবনে সিনার শিক্ষা ভাবনা: জন্ম হতে ২ বছর বয়সকালকে ইবনে সিনা একটি নবজাতক শিশুর শিক্ষার সূচনা কাল হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভূমিস্ঠ হওয়ার পর হতে শিশুর সার্বিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ কীভাবে যত্ন করে পরিপূর্ণ শিশুতে পরিণত করতে হয়, তাও তিনি উল্লেখ করেছেন। এভাবে একটা শিশুকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত যত্ন করে বড় করার জন্য চিকিৎসা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি-ভঙ্গির আলোকে ইবনে সনা মতামত দিয়েছেন। এটাকে মূলত প্রাক-শৈশব কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর মতে এ সময় শিশুর শারীরিক গঠন কাঠামো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কথা বলার সামর্থ্য শিশুর মধ্যে জন্ম নেয় ও শিখন শুরুর উপযোগি হয়ে ওঠে শিশু। আর শিশুর শ্রবণ এবং ইন্দ্রিয় শিখণে মনোযোগি হওয়ার মত হয়ে পড়ে। ইবনে সিনা তাঁর ‘আল-কানুন’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, একটি শিশু ৬ বছর বয়সে পড়লেই তার প্রাক-শৈশবকালের অবসান ঘটে। আর প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুর অভিষেক ঘটানোর যথোপযুক্ত বয়স এটি। ইবনে সিনা বলেন, শিশু যখন ৬ বছর বয়সে পা দেয়, তাকে শিক্ষকের নিকট উপস্থিত করা উচিত এবং শিক্ষা দেয়া আরম্ভ করতে হবে। আমরা দেখতে পাই যে, ইবনে সিনা এ বয়সের শিশুদের শিখনের জন্য বিশেষ কোন বিষয়ের ওপর জোর দেন নি। তিনি বরং শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক  দিক দিয়ে শিশুর শিখণ যাত্রার কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষার বয়স: একটি শিশুর শিক্ষা জীবনকালের প্রাথমিক বয়সকাল হবে, ৬ বছর থেকে প্রায় ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত। ইবনে সিনার মতে, এ সময় শিশুকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে শিখণ-শেখানোতে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে খেলা-ধুলা হতে ক্রীড়া শৈলী এবং পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাগ্রহণে শিশুকে নিয়োজিত করতে হবে। এভাবে চলবে ১৪ বয়স কাল পর্যন্ত। আর আস্তে আস্তে শিশুকে খেলাধুলা হতে বিরত করে মনোযাগ শিখনের দিকে নিয়ে যেতে হবে।এ বয়সে একজন শিশু তার ধর্মগ্রন্থ, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিশু তোষ ছড়া, কবিতা, ভাষা শিখণ, ধর্মীয় বিধি-বিধান শিখবে। সকল শিশু এ সময় অনেকটা একই বিষয়গলো শিখবে। ইবনে সিনা মনে করেন, শিশুদের এ স্তরে দলীয়ভাবে বা সব ধরণের শিশুর একত্রে শিখনই উত্তম, এককভাবে নয়। তাঁর পরামর্শ হলো; শিশুদেরকে অন্য শিশুদের সাথে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে, বেড়ে ওঠতে দিতে হবে। এক শিশু অন্য শিশুর কছে শিখবে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে। একক শিশু একক শিক্ষকের নিকট নয়, অন্য শিশুদের সাথে শিখনেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক। এতে কোন পক্ষই ক্লান্ত হয়ে পড়বে না। শিশু ও না, শিক্ষকও না।এ প্রক্রিয়ায় শিমু দ্রুত শিখবে এবং অন্য শিশুদের সাথে আকর্ষণ বোধ করবে ও সফল হবে। এভাবে একটি শিশু ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিখতে থাকবে। অতপর শিশুর মনোভাব বা শিখন আগ্রই প্রকাশ করে দেবে যে, ঐ শিশু বিষয়ে শিখণে ভাল করবে। সে কী উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের উপযোগি, নাকি কারিগরী শিক্ষা গ্রহন করে জীবিকা অর্জনের উপযোগি হবে। এ সময়ে সে কী পড়বে, না পড়বে, তাকেই পছন্দ করতে দেয়া উচিত। কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। সে যা চায়, শিক্ষক বুঝতে পারবেন, সে পারবে কিনা। আর শিক্ষার্থী বা শিশুর সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী তার পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া এবং তাকে তা পড়তে সুযোগ করে দিলেই, ভবিষ্যতে সে ভাল করবে।
প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষা দান পদ্ধতি: ইবনে সিনা তার দেশ-কালের প্রেক্ষাপটে ধর্মগ্রনন্থ শিখণ, মুখস্থকরণ এবং ধর্মীয় রীতি-নীতি প্রভৃতিকে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে শিখন-শেখানোর বিষয়বস্তুর কথা বলেছেন। সেসাথে তিনি শিশুর শারীরিক, মানসিক, মানবিক ও নৈতিক বিকাশের কথাও বলেছেন। আজকের যুগে আমরা ভাষা শিখণ, বিজ্ঞান, গণিত, সমাজ বিজ্ঞান ও নৈতিক বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের শিক্ষাক্রমভুক্ত করতে দেখছি। ইবনে সিনার সে কালের ভাবনা ও বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা ভাবনার মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। তিনি ছড়া, কবিতা ও পঠন-পাঠনের ওপর এ স্তরে অধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছেন। বর্তমানেও আমরা তাই করছি। বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষায় পড়তে পারা বা যে কোন পঠন-পাঠন উত্তমরূপে করতে পারার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। আবার তিনি খেলা-ধুলা বা ক্রীড়া শৈলী চর্চার ওপরও জোর দিয়েছেন। তবে, উপরের স্তরে উন্নীত হওয়ার সময় খেলা-ধুলায় মনোযোগ কমিয়ে দিয়ে পড়াশোনাকে অধিক গুরুত্ব দিতে বলেছেন, তিনি।ইবনে সিনার প্রাথমিক শিক্ষা ভাবনা ও আধুনিক মনোবিজ্ঞানীগণের শিক্ষা ভাবনা অনেকটা একই। বয়স, সামর্থ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত ব্যাখ্যাসমূহ হুবহু সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের জন্য বয়স, সামর্থ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন, ইবনে সিনাও তাই বলেছেন। আর আধুনিক যুগের শিক্ষাবিদ এবং মনোবিঞ্জানীগণও একই কথা বলছেন।

পরিশেষে বলব, প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের সবার উচিত শিক্ষাবিদগণের ভাবনাগুলো আমাদের পড়তে হবে। সে আলোকে ‍শিশুদের নিয়ে কাজ করব। পড়াব তাদেরকে, গড়ে তুলব। তৈরি করব মানসম্মত শিশু। একবিংশ শতাব্দীর শিশু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন