ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের গল্প
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী,
কক্সবাজার।
দেশে-বিদেশে
বিদ্যালয় ত্যাগ করা বা ঝরে পড়া অনেক শিশু কর্মজীবনে সফল হয়েছে। যে কোন কারণেই হোক
কোন কোন শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আবার পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। সেটা হতে পারে
দারিদ্র্যের কারণে অথবা অভিভাবকের অবহেলা বা অসচেতনতার কারণে। অথবা এমনও হতে পারে
শিক্ষগণের কড়া আচরণ বা মারদরের কারণে। আবার এমনও হয়, কোন শিক্ষার্থী সাময়িকভাবে
বিদ্যালয় ত্যাগ করার পর পুণরায় পড়াশোনায় ফিরে এসে বা অন্য কোন দক্ষতা অর্জন করে
অনেক বড় বা মহান হয়েছেন। আমাদের দেশে এমন এক বরেণ্য ব্যক্তি হলেন, বাংলাদেশ
ব্যাংকের বর্তমান গভর্ণর ড. আতিউর রহমান। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মাইক্রো সফটের জনক
বিল গেটস, এ্যাপল কম্পিউটারের জনক স্টিভ জবসসহ এমন কিছু খ্যাতিমান ব্যক্তি আছেন,
যাঁরা পড়াশোনা মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে সফল
হয়েছেন। অতএব, কোন শিশু একবার বিদ্যালয়ে পড়তে এসে, তা হতে বিমুখ হয়ে গেলে তাদেরকে
অবহেলা না করে, পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনার জন্য বার বার চেষ্টা করা বা উদ্যোগ নেয়া উচিত।
এমন কিছু উদ্যোগ আমাদের সরকারিভাবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ‘সেকেন্ড চান্স’,
আনন্দ স্কুল প্রকল্প এবং ব্রাকসহ বেশ কিছু বেসরকারিভাবে পরিচালিত সংস্থা ঝরে পড়া
বা বিদ্যালয় বিমুখ শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যাহোক, এ নিবন্ধে ঝরে পড়া শিশুদের
বিদ্যালয়ে ফিরে এসে বিখ্যাত হয়েছেন, এমন কিছু ব্যক্তিত্বের ওপর আলোকপাত করে
তাদেরকে শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার জন্য কিছু কৌশল তুলে ধরা হবে।
ড. আতিউর রহমান: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান একজন সফল মানুষ।যিনি ছিলেন একজন ঝরে পড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়
শিশু।জামালপুর জেলার অজ পাড়া গাঁয়ে তাঁর বাড়ি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় মা-বাবার
আর্থিক অনটনের কারণে বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন, তিনি।পরে নিজের উপলব্ধি থেকে
বালক আতিউর; বড় ভাইকে পড়াশোনায় ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে আবার স্কুলে পড়তে যান।
বিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের অবহেলার শিকার হলেও, তিনি জেদ করে পড়াশোনা
চালিয়ে গিয়ে চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হন। পরে পঞ্চম শ্রেণিতে
টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের গন্ডি পার হয়ে হাইস্কুলে ভর্তি
হন। ৭ম শ্রেণিতে ওঠার পর গ্রামের এক মৌলভী চাচার সহযোগিতায় এবং গ্রাম্য হাটে চাঁদা
তুলে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। আর কলেজ অধ্যক্ষের বদান্যতায়
বিনা খরচে পড়াশোনা করে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতি
বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাশ করে একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে
নিয়োগ পান। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন ও নীতি অধ্যয়ন বিভাগে শিক্ষক
ছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার, তাঁকে প্রথমে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরে
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ দান করে ও অদ্যাবদি তিনি এ পদে
দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।অধ্যাপক আতিউরের মত আমাদের দেশের গ্রাম-বাংলা হতে ওঠে
আসা আরও অনেকে আছেন, যাঁরা একবার বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়ে আবার পড়াশোনা আরম্ভ করে বিখ্যাত
হয়েছেন।
বিল গেটস: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও মাইক্রোসফটের জনক
বিল গেটস, স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে পড়তে গিয়ে ছিলেন, বিখ্যাত হার্ভার্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বিশ্বখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা তাঁকে ধরে রাখতে
পারে নি। তিনি কিছু একটা করার জন্য ওঠে-পড়ে লেগে থাকেন। শুরু করেন, কম্পিউটার
সফটওয়্যার নির্মাণের কাজ। সঙ্গি-সাথী মিলে তাঁর ভাবনার নাম দেন, মাইক্রোসফট। আর
একটার পর একটা কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করে বাজারে ছাড়তে থাকেন। এভাবে তিনি অর্থ
ও খ্যাতি দু‘টিই পেতে থাকেন। এক পর্যায়ে কম্পিউটার তথ্য-প্রযুক্তি জগতে বিপ্লব
ঘটিয়ে ফেলেন। আর বর্তমান বিশ্বে তিনি এক নম্বর ধনী ব্যাক্তি। তাঁর সম্পদের হিসেব হয়ত
তিনি নিজেই ভাল করে বলতে পারেন না।কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পড়াশোনা করতে
না পারার খেদ, তাঁর এখনও রয়ে গেছে।
স্টিভ জবস: বিল গেটসের মতই কম্পিউটার প্রযুক্তি জগতে সাফল্য বয়ে
আনা আরেক বিখ্যাত ব্যাক্তি হলেন, স্টিভ জব্স।তিনি পারিবারিক ঝামেলার কারণেই উচ্চ
মাধ্যমিক স্তরের পড়াশেনা ছেড়ে দিয়ে এ্যাপল নামক কম্পিউটার তৈরি, উন্নয়ন এবং বিকাশ
ঘটানোর কাজ করে দুনিয়াজোড়া প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।কম্পিউটার ব্রান্ডের সাথে যাঁরা
পরিচিত; তারা এ্যাপল, ম্যকিন্তোস, এইচপি, ডেল; এসবের নাম জানেন। এ্যাপল,
ম্যাকিন্তোষ, কী-বোর্ড, কম্পিউটারে খেলনা তৈরি প্রভৃতির সাথে জড়িয়ে আছে, স্টিভ জবসের নামটি। তিনি ৩/৪
বছর আগে পরলোক গমন করেন।এভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেকেই বিখ্যাত হয়েছেন, অথচ
ছিলেন, স্কুল পালানো বা ফেল করা ছাত্র/ছাত্রী।ব্যবসায় জগতে গাড়ি ব্যবসায়ি হেনরি
ফোর্ড, বিজ্ঞান জগতে আইনস্টাইন, চার্লস ডারউইন, আইজ্যাক নিউটন, রাজনীতির জগতে
আব্রহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, জন মেজর, কবি-সাহিত্য জগতসহ অনেক ক্ষেত্রে স্কুল
পালানো বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিমুখ হয়েও পরে কর্মজীবনে অনেকেই এমন সব সাফল্য
বয়ে এনেছেন; যাঁদেরকে ভবিষ্যতে কেহই অতিক্রম করে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে।
ঝরে পড়া রোধ করার কতিপয় কৌশল: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ।সম্প্রতি, আমরা শুনছি
বাংলাদেশ একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।এদেশে এখনও সকল
মা-বাবা তাদের সন্তানদেরকে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর ও পরবর্তী শিক্ষা স্তরের পড়াশোনা
করানোর মত মন-মানসিকতা বা আর্থিক সামর্থ্য নেই। তাদের সন্তানদের মৌলিক চাহিদাসহ
অন্যান্য চাহিদা পূরণ করে নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠানো এবং পুরো শিক।ষা জীবন সমাপন
করানোর মত নন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ অভিভাবক।ফলে, বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি
করিয়ে তারা তাদের সন্তানদের পঞ্চম শ্রেণি ও পরবর্তি শিক্ষা স্তরেও, নিরবিচ্ছিন্ন ও নিয়মিত পড়াশোনা করার সুযোগ করে
দিতে পারেন না। আবার নিজ গ্রামে বা বাড়ির নিকটে বিদ্যালয় না থাকায়, তারা পড়াশোনায়
আগ্রহী হয়ে ওঠেনা, পুরোপুরি। তাছাড়া, চরাঞ্চল, দ্বীপাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় অনেক
জনগোষ্ঠী আছে, যারা সহজাতভাবেই অসচ্ছল পেশা ভিত্তিক জীবন-যাপন করে থাকে। অনেকেই
আবার দিনে আনে, দিনে খায়; এমন মানুষেরা তাদের সন্তানদের বিদালয়ে পাঠানো এবং
অব্যাহত শিক্ষা গ্রহন করনোর ঝুঁকি নিতে পারে না। আর এসব বিবেচনা করে সরকার
উপবৃত্তি সুবিধা প্রদান, মিড-ডে মিল চালু, প্রতিবন্দ্বী শিশুদের বিশেষ
সুযোগ-সুবিধা প্রদান, প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় বিদ্যালয প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন
উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তাছাড়া, ঝরে পড়া রোধ, এবং বিদ্যালয় বিমুখ
এবং শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য নিন্মোক্ত কৌশলসমূহ অবলম্বন
করা যেতে পারে।
১.ক্যাচমেন্ট
এলাকার বিদ্যালয় গমনোপযোগি প্রত্যেক শিশুর নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে
হবে।
২.
বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক শিশুর সাথে সমান আচরণ করতে হবে।
৩.
দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারের শিশুদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং নমনীয় আচরণ করা।
৪.
পড়াশোনায় দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া শিশুদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া।
৫.
দারিদ্র্যপীড়িত ও পশ্চাতপদ পরিবারের অভিভাবকদেরকে তাদের শিশুদের পড়াশোনা করানোর
প্রতি উৎসাহ দেয়া, সচেতন করা এবং তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা।
৬.
অসচ্ছল পেশার অভিভাবকগণকে সম্মান দিয়ে কথা বলা এবং তাদেরকে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা।
৭.
কোন শিশু যাতে শিক্ষা বঞ্চিত না হয়, এমন অঙ্গীকার ও দেশপ্রেম প্রত্যেক শিক্ষকের
থাকতে হবে।
৮.
বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষককে সর্বস্তরের এলাকাবাসী এবং অভিভাবকদের নিয়ে নিয়মিত বসা এবং
তাদের নিয়ে সমাবেশের আয়োজন করা।
৯.
শিক্ষার উপকারিতাসমূহ অসচেতন ও অসচ্ছল অভিভাবকগণকে বার বার অবহিত করা।
১০.
দেশের প্রত্যেক নাগরিককে মর্যাদা দিয়ে তাদের মাঝে দেশপ্রেম এবং জাতীয় উন্নয়নে
অবদান রাখতে উৎসাহ যোগানো।
১১.
হোম-ভিজিট, ওঠান বৈঠক, মা-সমাবেশ, অভিবাবক সমাবেশসহ উদ্বুদ্ধকরণ সভাসমূহ বেশি বেশি
আয়োজন করা।
১২.
সর্বোপরি, একটি দেশের প্রত্যেক নাগরিক শিক্ষিত হলে, সে জাতি ও দেশ যে, উন্নত হয়
এরকম উন্নতি করে এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তি, দেশ এবং জাতির উদাহারণসমূহ অভিভবকগন বা
এলাকাবাসীর সামনে বার বার তুলে ধরলে, কাংখিত উপকার এবং শিক্ষা সচেতনতা আসতে পারে,
আসবে।
উপসংহার: উপরে বিদ্যালয় হতে ঝরে পড়া বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
বিমুখ কিছু দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তির উদাহারণ উল্লেখপূর্বক সকল শিশুর
বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং শিখন-শেখানো অব্যাহত রাখার কতিপয় কৌশল নিয়ে আলোচনা করা
হয়েছে।প্রত্যেক শিক্ষক এবং অভিভাবক যদি আন্তরিক হোন এবং শিক্ষা সচেতন হন, তাহলে
পুরো জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা ও উন্নয়ন ঘটানো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন