একবিংশ শতাব্দীর
শিখণ-শেখাণো:
শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক
শিখণ ভাবনা
মোহাম্মদ
শহীদুল্লাহ
সহকারি
উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী,
কক্সবাজার।
একবিংশ শতাব্দীর বিদ্যালয় ও
শ্রেণিকক্ষগুলোকে আমরা কেমন দেখতে চাই?আমরা চাইব, বিদ্যালয়গুলো হবে পুরোপুরি
শিশুবান্ধব-আনন্দদায়ক শিখণ সহায়ক পরিবেশ সম্পন্ন এবং শ্রেণিক্ষগুলো
শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী-শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী মিলে
শিখণ-শেখাণোর বুদ্ধিদীপ্ত কার্যক্রমে ও আকর্ষণীয় প্রদর্শণীতে ভরে আছে। গতিশীল শিখণ
পরিবেশই একংবিংশ শতাব্দীর চাহিদা। অত্যন্ত কার্যকর এক শিখণ কৗশর হলো,
শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখন। কিন্তু শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখণ বলতে আমরা কী
বুঝি?আসলে এটাকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। শিখণ বিষয়টা একক বা ব্যক্তি বিশেষ কেন্দ্রিক,
তাই এটা আপেক্ষিক একটা বিষয়ও বটে।এতে আছে কৌতূহল, বিশ্বাসযোগ্যতা ও
ভালবাসা-স্নেহাশীষ প্রবণতা। আর শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখণকে আমরা নিন্মোক্ত ১০ টি
বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। টেরি হিক নামক একজন মার্কিন শিক্ষাবিদের
ভাবনাগুলোকে আমি এখানে তুলে ধরছি।
শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক শিখণ-শেখাণোর ১০
টি বৈশিষ্ট্য:
১.শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করবে, উত্তম প্রশ্ন: প্রশ্নগুলো আরোপিত হবেনা।
হবে স্বতস্ফূর্ত এবং শিক্ষার্থীরা নিজেরাই করবে। পাঠ চলাকালেও হবে, শেষেও
হবে।শিক্ষকগণ সাধারণত: শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেন পাঠ শেষে। এটা হবে না,
শিক্ষার্থীর মনে যখনই কোন কিছু জানার ইচ্ছা হবে, জানার জন্য প্রশ্ন করবে। শিক্ষক
শুধু লক্ষ্য রাখবেন, প্রাসংগিক হচ্ছে কিনা প্রশ্নগুলো। আর শিক্ষকককে সব প্রশ্নের
জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কোন প্রকার বকা-ঝকা করা যাবে না।
শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে শিক্ষক সময় নিয়ে, প্রস্তুতি নিয়ে জবাব
দিবেন।অথবা পরের পাঠে তা ভালভাবে বুঝিয়ে দিবেন।
২. প্রশ্ন হবে উত্তরের চেয়ে মূল্যবান: প্রশ্নগুলো এমন হবে, যা প্রাপ্ত
উত্তরের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রশ্নগুলো শিখণ ফল অর্জন করানোর জন্য হবে,
খুব মূল্যবান। শিক্ষক পাঠদানের সময় শিখণ ফল ভিত্তিক পয়েন্টগুলো শিক্ষার্থীদের
সামনে তুলে ধরবেণ এবং বোর্ডে-দেয়ালে প্রদর্শন করবেন।আর তাদেরকে কৌতুহলী করে তুলবেন।
এতে শিক্ষার্থীরা মজা পাবে ও জানার জন্য প্রশ্ন করবে।
৩. বৈচিত্রময় উৎস হতে প্রশ্ন আসবে: পাঠ নির্বাচন, পঠন-পাঠন, পাঠের
বিষয়বস্তু উপস্থাপনের ধরণই শিশুদের মস্তিস্কে বৈচিত্রময় প্রশ্নের উদ্রেক করবে এবং
তারা প্রশ্ন করে যাবে। এমনও হতে পারে প্রশ্ন বান শিক্ষককে হাঁপিয়ে ওঠাচ্ছে, কিন্তু
ধৈর্যহারা হতে পারবেন না, তিনি। তিনি, বার বার সূত্র ধরে দেবেন। আপনার সীমাবদ্ধতা
থাকলে আপনি শিক্ষক হিসাবে অপনার চেয়ে যাঁরা বেশি জানেন তাঁদের ধারস্থ হবেন এবং
জেনে নিবেন।পরে শিক্ষার্থীদেরকে জানাবেন।
৪. বৈচিত্র্যময় শিখণের ধরণ শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন: অনুসন্ধানমূলক
শিখণ, প্রজেক্ট-ভিত্তিক শিখণ, সরাসরি শিখণ, জোড়ায়-জোড়ায় শিখণ, এক বিদ্যালয়ের মডেল
আরেক বিদ্যালয়ে উপস্থাপন, প্রযুক্তি ভিত্তিক শিখণ, মোবাইল ব্যবহার করে শিখণ,
শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন বিষয়ও জিনিষের সমাহার ঘটানোসহ নানা রকম শিখণ-শেখানোর পদ্ধতি
বা উপকরণ শিক্ষার্থীদের সন্মুখে হাজির করতে হবে। শিক্ষার্থীরাই বুঝে নিবে কিসে
তাদের উপকার বেশি হয়। তারা যেভাবে চাইবে সেভাবে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা
করতে হবে। আপনার উদ্দেশ্য হবে শিখণ ফল অর্জন করানো। সেটা যেভাবেই হোক আপনাকে করতে
হবে।
৫. শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিখণ: শিক্ষার্থীরা যদি চায়, তাদেরকে শ্রেণির
বাইরে নিয়ে যাবেন, শিক্ষক। একটি উচ্চস্তরের শিখণ শুধু একটি কক্ষে আবদ্ধ রাখলে
যেখানে শুরু, সেখানেই অনেক ক্ষেত্রে শেষ হয়ে যেতে পারে। উদাহারণ হিসেবে শেক্সপিয়ার
বা রবীন্দ্রনাথকে বিবেচনা করা যায়। তাঁরা
প্রাতিষ্ঠানিক বা শ্রেণিকক্ষ শিখণে বেশি শিখতে সক্ষম হন নি। তাঁরা অনানুষ্ঠানিক
শিখনেই বেশি উপকৃত হয়েছেন, বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। শেক্সপিয়ার শিখেছেন নাঠকের
মঞ্চে। আর রবীন্দ্রনাথ শিখেছেন ঘরে বসে পড়ে পড়ে, বেশি।এসব কৌশলও আজকের যুগের
শিক্ষকদেরকে, মডেল হিসেবে নিয়ে শিখণ-শেখানোর কাজে প্রয়োগ করতে হবে।
৬.বিচিত্র সব কৌশল প্রয়োগে শিখণকে ব্যাক্তিগতকরণ করে তোলা: আগামীতে
শিখণের কাজটি হয়ে পড়বে ব্যক্তিগত বা নিজ নিজেউদ্যোগে শিখণ প্রক্রিয়ায়। বর্তমানে
শ্রেণিকক্ষে সব কাজ শিক্ষকেরই করতে হয়।বৈচিত্রায়িত কৌশলে ব্যাক্তিগত শিখণকে রূপায়িত
করা যায়।শুধু পরীক্ষায় ভাল করার জন্য নয়, সব ধরণের শিখণ-শেখাণোতেই ব্যাক্তিগত
শিখণের পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।প্রথম প্রথম এ পদ্ধতিটি অকার্যকর মনে হতে
পারে, কিন্তু এটাও একটি উত্তম শিখণ পদ্ধতি বলে প্রমাণিত হবে।ভবিষ্যতে এটি হয়ে যেতে
পারে প্রধান শিখণ-শেখানো কৌশল।
৭. মূল্যায়ন করা হবে অব্যাহতভাবে,বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে, স্বচ্ছভাবে এবং কখনো
শাস্তিমূলক নয়: মূল্যায়নের লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীর শিখণ যাচাই করা। বেশি বেশি
মূল্যায়ন, ক্লিনিক্যাল পদ্ধতিতে মূল্যায়ন ও চাপে রাখার জন্য মূল্যায়ন করা হলে তা
ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য অনেক সময় উপকারের চেয়ে অপকার বয়ে আনতে পারে।এতে ভাল
ছাত্র/ছাত্রী তৈরি করতে গিয়ে ভাল চিন্তাবিদ গড়ে তোলার সুয়োগ হারিয়ে যেতে পারে।
যাহোক, মূল্যায়ন বেশি বেশি না করে, বিলম্ব না করে ফিডব্যাক দেয়াই উত্তম কৌশল হতে
পারে। শিক্ষার্থীদের শিখণ সহায়ক তথ্য প্রদান করাই ফিডব্যাক্। সুতরাং
আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক অতি মূল্যায়ন করার চেয়ে ফিডব্যাক প্রদান প্রক্রিয়া
কার্যকর রাখাই উত্তম হতে পারে।
৮. সাফল্য যাচাইয়ের মাপকটি হবে সুষম এবং স্বচ্ছ: ছাত্র/ছাত্রীরা একটি অতি
কার্যকর শ্রেণি শিখণের সাফল্য কী হবে তা নিয়ে ভাববে না।আর এটা এমনও হবে না যে,
তাদের অংশগ্রহণ পুরোপুরি সক্রিয়করণ, ফলাফল মূল্যায়ন, দৃষ্টিভঙ্গি বা অন্যান্য
ব্যাক্তিগত বিষয় বিবেচনা করা, বরং তা হবে
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অর্থবহ প্রক্রিয়া। আর তা অন্য কারো মধ্যে হবে
না, হবে ছাত্র/ছাত্রীদের নিজেদের মাঝে।
৯. শিখণ অভ্যাসই হবে সব সময়ের আদর্শ: জ্ঞানমূলক শিখণ, আধা-ঞ্জানমূলক শিখণ
লক্ষ্য অর্জনমূলক শিখণ প্রচেষ্টাই আদর্শস্থানীয় পন্থা বলে বিবেচিত হবে সকল সময়।
কৌতূহল, অধ্যবসায়, নমনীয়তা, অগ্রাধিকার, সৃজনশীলতা, সহয়োগিতাশূলক মনোভাব, বার বার
শিখণ এবং এমন কি শ্রেণি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ সব কিছুই কাজ শুরুর মানসিক অভ্যাসে
পরিণত করতে হবে।অতএব, শিক্ষার্থীরা তাদের চারিপাশ হতে যা শিখে তা হবে কম
প্রত্যক্ষণ এবং অধিক পরোক্ষ ও পর্যবেক্ষণমূলক।
১০. অনুশীলণ কার্ক্রম চালিয়ে যাওয়ার
জন্য প্রতিনিয়তই পর্যাপ্ত সুযোগ থাকবে: পুরনো ভাবনা বা শিখণ-শেখানোর কৌশলগুলোতে
ফিরে যেতে হবে। সেগুলোকে নতুন কৌশলের সাথে সমন্বয় করে নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করতে
হবে। প্রাচীন শিক্ষাবিদগণ যা অনুসরণ করতে বলেছেন বা যে সব কৌশল প্রয়োগের কথা
বলেছেন, তা একবারে পরিহার না করে তা থেকেও প্রযোজ্য ও প্রাসংগিক বিষয়গুলো অবলম্বন
করা যেতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন